বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা ঘটনার মূল হত্যাকারীদের মধ্যে অন্যতম রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ড। অনেক আগে থেকেই তারা দু’জনই ছিলেন বেতাগী এলাকায় অপরাধ জগতের অতি পরিচিত মুখ। তাদের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।
মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলেন রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ড। বেতাগী এলাকায় প্রতিবেশীদের ওপর হামলা, মারধর করা নয়ন ও রিফাতের কাছে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এক কথায় বলা যায়, এ সংঘবব্ধ সন্ত্রাসী দলটি সংশ্লিষ্ট এলাকাকে অপরাধের দুর্গ গড়ে তুলেছিল। একাধিকবার গ্রেফতার হলেও বিত্তশালী বাবার রাজনৈতিক তফবিরের কারণে তারা অল্প দিনের মধ্যেই মুক্তি পেয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেন রিফাত ফরাজী ও তার সংঘব্ধ দলের সদস্যরা। আহত তরিকুল জানান, একদিন রিফাত ফরাজীর সঙ্গে তার সামান্য কথা কাটাকাটি হয় । এর জের ধরে রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে যখম করার হুমকি দেন। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে বাসায় যাওয়া আসা করতেন। হুমকি দেয়ার দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় তরিকুল রিফাত ফরাজীর বাসার সামন দিয়ে তার বাসায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে রিফাত ফরাজী, নয়ন ও তার সহযোগীরা দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে মাথায় গুরুতর জখম করেন। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
এদিকে একই বছর রিফাত বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রদের জিম্মি করে, তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন।
এ বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ডিকেপি রোডের আমাদের ভাড়া দেয়া বরগুনা পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করেন রিফাত ফরাজী। এ ঘটনা জানার পর আমি বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করায় রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। তিনি রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি ৩টি মোবাইল উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান। এছাড়া ২০১৭ সালে বরগুনায় ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইন ও দেশীয় অস্ত্রসহ ফরাজী ও নয়নকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মারজানা মনি বলেন, ২০১৭ সালের রমজান মাসে আমার ছোট ভাই হাফেজ মেহেদী হাসান বরগুনার হোমিও চিকিৎসক আলাউদ্দিন ডাক্তারের বাসা সংলগ্ন মসজিদে তারাবির নামাজ পড়াত। তখন রিফাত ফরাজী একদিন মেহেদীর কাছ থেকে মডেলের বিদেশ থেকে আনা স্যামসাং গ্যালাক্সি কোর প্রাইম একটি ফোন ছিনিয়ে নেয়। বিষয়টি তার মা-বাবাসহ স্থানীয় অনেককে জানানোর পরও আমার ভাইয়ের মোবাইলটি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারেনি। ওই সময় বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করার পর সাড়ে ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে মোবাইলটি ফিরিয়ে দিয়ে হুমকি দেন রিফাত ফরাজী। পরে রিফাত ফরাজীর হুমকিতে ওই এলাকা ছেড়ে এক প্রকার পালিয়ে চলে আসে আমার ভাই।
অপরদিকে বরগুনা সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে বরগুনা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে নয়ন বন্ডের (২৫) বাসা। নয়নের বাবা মৃত ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। নয়নের বড় ভাই মিরাজ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর প্রবাসী হওয়ার কারণে মাকে নিয়ে ওই বাসায় বসবাস করছে নয়ন। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন বন্ডের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক, দুটি দেশীয় অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসব মাদকের মধ্যে ছিল ৩০০ পিস ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল ও ১০০ গ্রাম হেরোইন।
এ সময় নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী ইমামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী ইমামের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে। পরে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসে নয়ন বন্ড। জেল থেকেই বেরিয়ে মূলত এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় নয়ন।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, এভাবে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে তার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা! স্ত্রী শত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলেন না স্বামী রিফাতকে। এমন নৃশংস ঘটনা কারও কাম্য নয়। কিন্তু যে দুই যুবক এই হত্যালীলা চালালেন, তারা কারা? এ প্রশ্ন এখন দেশবাসীর। সবাই জানতে চাচ্ছেন, এদের শক্তির উৎস কী?
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকারী দুই জনের একজনের নাম রিফাত ফরাজী ও অপরজন নয়ন (২৫) বন্ড। অনেক আগে থেকেই তারা দুইজনই নিজেদের এলাকায় অপরাধ জগতের পরিচিত মুখ। তাদের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবীর হোসেন মাহমুদ বলেন, নয়ন বন্ডের মাদক বাণিজ্যের কথা আমরা জানি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলার কথাও আমরা জেনেছি। এর আগে, নয়ন ও তার সহযোগী জেল খেটেছে। জামিনে তারা বেরিয়ে যায়। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ফরাজী ও নয়নসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের আটকের চেষ্টা চলছে।
এইচ এম/একেএস