রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে। রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৪ জুলাই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ৩২ জন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, মার্চ থেকেই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গত দুই মাসে এ রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবং হাসপাতালের নাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় নেই। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ কন্ট্রোল রুমে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ বলেন, কোনো হাসপাতালে কত ডেঙ্গুরোগী তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৭১ জন রোগী। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ২২ জন। সরকারি হিসাব বলছে, ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। যদিও সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, মৃত্যু সংখ্যা মোট ১২ জনের। সর্বশেষ একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার চার বছর বয়সী মেয়ে সোমবার (১৫ জুলাই) রাতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গু পরিস্থিতি তালিকায় সেই মৃত্যু যোগ করা হয়নি। এর আগেও ডা. নিগার নাহিদ দিপু নামের একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে। তবে সেই মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়নি বলে জানিয়েছে কন্ট্রোল রুম।
রাজধানীর অন্যতম বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইডের কমিউনিকেশনস বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার সাইফুর রহমান লেনিন বলেন, ‘প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন করে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে আসছেন। প্রায় ১০-১৫ দিন ধরে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে। কাউকে ভর্তি রাখা হয়, আবার কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে চলে যান।’ অথচ সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, ল্যাবএইডে গত ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র একজন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
গ্রিন রোডের আরেক বেসরকারি হাসপাতাল হেলথ অ্যান্ড হোপে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে মে মাস থেকে। তবে হাসপাতালটির নাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমে ডেঙ্গু রোগীর তালিকায় নেই। একইভাবে মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তৌসিফ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, কিন্তু এই হাসপাতালের নাম নেই স্বাস্থ্য তালিকায়। গত ১২ জুলাই উত্তরা উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন হুমায়ুন কবীর। অথচ সরকারি হিসেবে এই হাসপাতালে কোনও ডেঙ্গু রোগীর কথা বলা হয়নি। একইভাবে মগবাজারে অবস্থিত ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী থাকলেও হাসপাতালটির নাম আসেনি সরকারি হিসাবে।
হাসপাতালের ম্যানেজার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘মূলত কিডনি রোগের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও আশেপাশের এলাকা থেকে রোগী আসছেন। এ পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৪০ জনের মতো ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।’
মহাখালীতে অবস্থিত ইউনির্ভাসেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সাবেক আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল) সোমবার (১৫ জুলাই) ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ৩০ জন। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘গত এক থেকে দেড় মাস ধরে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তবে সেটা প্রকট আকার ধারণ করেছে গত ১৫ দিন ধরে।’ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে কেউ মারা না গেলেও কয়েকজন রোগীর অবস্থা খুব খারাপ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এক চিকিৎসকের ৭ বছরের সন্তান লাইফ সাপোর্টে আছে গতকাল (রোববার) রাত থেকে। আরেক চিকিৎসকের চার বছরের সন্তানও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।’ অথচ সরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছেন ২৭ জন, তাদের মধ্যে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ১৪ জন রোগী ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন সাত জন। এ তথ্য জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক। অথচ সেখানে এখন পর্যন্ত কোনও ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নেয়নি বা ভর্তি নেই বলে সরকারি তালিকায় দেখা যায়।
কন্ট্রোল রুমের তালিকায় এসব হাসপাতালের নাম নেই কেন জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আখতার বলেন, ‘এখানে দুই পাতার মধ্যে এতোকিছু ইনক্লুড (অন্তর্ভুক্ত) করা যায় না। এ বিষয়ে একটা সফটওয়্যার তৈরি করার কথা। সেটা যখন হয়ে যাবে, তখন সব হাসপাতালের সব তথ্য ইনক্লুড হবে।’
কিন্তু গ্রিন লাইফ কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হাসপাতালের তথ্যও তালিকায় নেই। সেখানে হাসপাতালের নাম রয়েছে, কিন্তু রোগীর সংখ্যা শূন্য দেখানো হয়েছে। এটা তো সফটওয়্যারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব হাসপাতাল সব রিপোর্ট দেয় না, অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু তারা রিপোর্ট দেয় না। এটা নিয়ে অনেকদিন ধরেই কথা বলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে দায় কার প্রশ্নে তিনি বলেন, হাসপাতালের দায়। তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে, প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা তথ্য পাই নাই।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘দায় দুই পক্ষেরই, দায়িত্ব উভয়েরই। তবে হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়টাই বেশি । কিন্তু আমরাও দায়িত্ব পালন করছি না ঠিকমতো।
টিএইচ/টিএফ