• ঢাকা
  • বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০১৯, ০৩:২৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১২, ২০১৯, ০৩:২৬ পিএম

এক টুকরো মাংস নিতে সপরিবারে শহরে পারভীন

এক টুকরো মাংস নিতে সপরিবারে শহরে পারভীন
কোরবানির মাংস নিতে গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন পারভিন আক্তার  -  ছবি : জাগরণ

রিয়াজ, জুয়েল, ফারজানা, রুবিয়া, জাহিমা, সুহেল, সামছুদ্দিন তাদের বয়স তিন থেকে ১১ এর মধ্যে। এই শিশুদের সঙ্গে করে সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের উমেদশ্রী গ্রাম থেকে মাংস সংগ্রহের জন্য ১০০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার নুতনপাড়ায় এসেছেন তাদের মা পারভীন আক্তার (৩৮)।

শহরের এসে নুতন পাড়া জনস্বাস্থ্য অফিসের সামনে তাদের নিয়ে বসে আছেন কোরবানির মাংস পাওয়ার আশায়। কিন্তু তখনও গরু কাটাকাটির কাজ চলছে ভেতর বাড়িতে। তাই কেউ প্রধান গেইট খুলে দিচ্ছেন না। ছোট গেইটের সামনে একজন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ যেন বাড়িতে ঢুকতে না পারে। মাংস কাটা শেষ হলে গেইট খোলে প্রত্যেকের হাতে এক টুকরো করে মাংস তোলে দেয়া হবে।

কোরবানির গোশত সংগ্রহের জন্য শহরের জামাইপাড়া মোড়ে দরিদ্র মানুষের অপেক্ষা  -  ছবি : জাগরণ

পারভীন জানায়, উমেদশ্রী গ্রামে কোরবানি দেয় খুব কমসংখ্যক মানুষ। তাই যেটুকু মাংস গ্রাম থেকে পাওয়া যায়, তা দিয়ে তরকারি রান্না করা যায় না। তাই সকাল ৭টায় শহরে চলে এসেছেন মাংস পাওয়ার আশায়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গেইটে পাশে থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াকুব উল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী জাহিমা আক্তার (১১)। সে জানায়, আগে থেকে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মাংস পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। তাই সে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 

রঙ্গারচর ইউনিয়নের সফেরগাঁও গ্রামের দিনমজুর সেলিম মিয়া বলেন, ভোর থেকে পরিবারের লোকজন নিয়ে ৭০ টাকা দিয়ে ইজিবাইকে চড়ে স্বপরিবারের শহরে এসেছেন তিনি। ঘরে চাল ডাল নুন তেল সব আছে কিন্তু মাংস নেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মাংস সংগ্রহ করে রাতে সবাই মিলে খাবেন।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের পূর্ব মেরুয়া খলাগ্রামের  ফাতেমা আক্তার বলেন, তার পরিবারের ছোট বড় মিলিয়ে ৭ জন। গ্রামে কোরবানির মাংস পাওয়ার আশা নেই। তাই তিনি একাই ৪০ টাকা লেগুনা ভাড়া দিয়ে শহরে এসেছেন পরিবারের জন্য মাংস সংগ্রহ করতে।

তিনি বলেন, গেলবারও তিনি শহরে এসেছিলেন। সারা দিন পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে তিন কেজি মাংস নিয়ে বাড়ি গিয়েছেন। পরে সেই মাংস দিয়ে ঈদেও মাংস খেয়েছেন তারা। 

মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ইছাগরি গ্রামের নুরুল হক বলেন, বাজারের ধানের দাম কম, গরুর দাম বেশি। তাই গেলবারের তুলনায় গ্রামে  কোরবানি কম হয়েছে। প্রতিমণ দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন কৃষক। এজন্য তিনি সন্তানদের মুখে ঈদের মাংস তোলে দেয়ার জন্য থলি নিয়ে শহরে এসেছেন।

পারভীন আক্তারের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন গণমাধ্যমকর্মী  -  ছবি : জাগরণ

হরিণাপাটি  গ্রামের করিমুনেচ্ছা বলেন, ঈদ ধনীদের জন্য আনন্দের বার্তা বয়ে আনলেও তাদের মতো খেটে খাওয়া লোকজন বাড়িবাড়ি ঘুরে এক টুকরো দুই টুকরো করে মাংস সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে গেলেই রান্নার হাঁড়িতে মাংস রান্না করা হবে।

কাঞ্চন মালা বলেন, ধার দেনা করে মাংস রান্না করার উপকরণ বাড়িতে কিনে নিয়েছিলেন অনেক আগেই। আজ তাদের গ্রামের ত্রিশজন নারী পুরুষ নৌকা ভাড়া করে শহরে এসেছেন মাংস নেয়ার জন্য। বিকেলে মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। তাই কাঠফাটা রোদে পুড়ে বাড়িবাড়ি ঘুরে মাংস সংগ্রহ করছেন তিনি। লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের বাহাদূর গ্রামের মিনারা খাতুন বলেন, ঈদের দিনে যদি এনজিওগুলো কোরবানির মাংস বিলি করতো তাহলে গরিব মানুষ শান্তিতে ঈদ করতে পারতো। 

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, সরকার ঈদে বিশেষ ভিজিএফ চাল দিয়েছে। কিন্তু দরিদ্র মানুষের বাড়িবাড়ি ঘুরে কোরবানির মাংস সংগ্রহ করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এজন্য বেসরকারি সংস্থা ও এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে ধনী-গরিব সবাই কোরবানির মাংস খেতে পারতেন।

জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়াম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইউসুফ আল আজাদ বলেন, হাওর এলাকায় দরিদ্র মানুষের বসবাস। তাদের আয়-রোজগার সীমিত। সবাই কোরবানি দিতে পারে না। এছাড়া এ সময় নৌকাযোগে সর্বত্র চলাচল করতে হয়। গরিব লোকজনের অনেকের নৌকাও নেই, তাই তাদের পক্ষে বাড়িবাড়ি গিয়ে কোরবানির মাংস সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এজন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমীর বিশ্বাস বলেন, হতদরিদ্রদের মধ্যে ইউনিয়র পরিষদের মাধ্যমে বিশেষ ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হয়েছে। কোরবানির মাংস দেয়ার জন্য সামাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাহলে তাদের এ কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।

জেলা প্রাণি সম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৩৮ জন তালিকাভুক্ত খামারি রয়েছেন। এসব খামারিরা ৫৯ হাজার ১০৯ টি পশু কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য তুলে ছিলেন। এগুলোর মধ্যে ষাঁঢ় ৩৫ হাজার ৮৫০টি, বলদ ১২ হাজার ৭৪৯টি, গাভী ৫ হাজার ১৩টি, ছাগল ৩ হাজার ৩২৪ টি, ভেড়া ১ হাজার ৩১৫টি। এই জেলার ১১টি উপজেলায় প্রায় ২৮ লাখ মানুষের বসবাস।

এমএইউ/এনআই

আরও পড়ুন