দুর্গাপুর সংবাদদাতা
অস্ত্র হাতে দেশকে স্বাধীন করলোও জীবনের শেষভাগে এসে বইতে হয়েছে প্রবল যন্ত্রণা। কথা বলা ও চলার শক্তি হারিয়ে জীবিত থেকেও ভোগ করেছেন মৃত্যুর স্বাদ। অসুস্থতায় নষ্ট হয়েছে চোখ। তারপরও চালিয়ে গিয়েছিলেন বেঁচে থাকার লড়াই। সুচিকিৎসা সন্ধানে পরিবার, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছুটেছেন বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে। তাতেও হয়নি কোন লাভ। এভাবেই দীর্ঘ পাঁচ বছরের আমৃত্যু যন্ত্রণার কাছে হার মেনে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলী। গত রোববার সকালে উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের দেওসিংহ গ্রামের নিজ বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার মাঠে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা মধ্য দিয়ে হয় শেষ বিদায়। সহযোদ্ধারা লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা আর গায়ে পড়িয়ে সম্মাননাও প্রদান করেন।
৭১ এ মহান মুক্তিযোদ্ধা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির সংগ্রামে সাড়া দিয়ে পরিবারের মা বাবা ও ৬ ভাইকে রেখে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আরশ আলী। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বাঘমারা, তুরাগ সহ বেশ কিছু এলাকায় প্রশিক্ষণ শেষে দেশমাতৃকাকে রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পাড়েন এই বীর সৈনিক। বিজয়পুর, ধোবাউড়া, পূর্বাধলা বিভিন্ন স্থানে লাল সবুজের পতাকা বুকে জড়িয়ে যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। তবে বেশিরভাগ সময়ই এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চোরে অনেকটা গেরিলা কায়দায় হামলা চালিয়েছেন পাক বাহিনীদের ক্যাম্পে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঘন জঙ্গলে ছিলো তাদের বসবাস। একদিকে পাকবাহিনী অন্যদিকে পাহাড়ের ভয়ঙ্কর জীবজন্তুর সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। তারপরও সব সময় সাহসিকতার সাথে লড়াই চালিয়ে শত্রুমুক্ত করেছেন নেত্রকোনার পূর্বধলা ও ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, হালুয়াঘাটের বেশ কিছু অংশ। স্বাধীনে স্বীকৃতি স্বরূপ পাচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদ, ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম সহ নিয়মিত পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও।
স্বাধীন লাল সবুজের নতুন দেশে ফিরে পরিবারকে নিয়ে আবারো তৈরি করেন নতুন সংসার। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে এসে দারিদ্র্যতার কাছে হার মানে গত পাঁচ বছর আগে থেকেই ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে শুরু করেন স্বাধীনতার এই বীর সৈনিক। ২০১৬ সালের শেষের দিকে ব্রেইন স্ট্রোক থেকে শরীরের এক অংশ হঠাৎ প্যারালাইজড হয়ে পড়েন তিনি। প্যারালাইজ হয়ে একে একে অচল হতে থাকে শরীরের অংশবিশেষ। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে কথা ও চলাফেরার ক্ষমতাও। পরিবারের সদস্যরা বেশ কয়েক বার স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলেও শারীরিক অবস্থার জন্য উন্নতি হয়নি। পরিবারের ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে এই সংসার চলছে অনেকটাই হিমশিম খেয়ে। তবে সরকারী ভাবে পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে পরিবারটি। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় দিন দিন মৃত্যুর কাছা কাছি আসছিলেন তিনি। ইতি মধ্যে একটি চোখ নষ্ট হয়েছে। শরীরের বাকী অংশের ব্যথায় সবসময় ভেজা থাকা আরেকটি চোখটিও। পরিবারের সদস্যরা জনপ্রতিনিধি সহ বিভিন্ন স্থানে গিয়েও তেমন কোনো আশার আলো দেখেনি।এই নিয়ে গত দুই বছরে আগে পরিবারের বড় সন্তান আবদুল কালামকে হারিয়ে আরো ভেঙে পড়েন পরিবারটি। পরিবারের উপার্জনক্ষম এই ছেলের উপরে নির্ভর করত বাবার চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ। তাই ছেলের মৃত্যুর পর অনেকটাই থমকে যায় আর বাবার আরশ আলীর চিকিৎসা ব্যবস্থা।
২০১৯ সালের শেষের দিকে তৎকালীন ইউএনও সহ ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে সুচিকিৎসার জন্য আবেদন করলেও বীর এই মুক্তিযোদ্ধার কপালে জুটেছিল একটি হুইল চেয়ার আর সামান্য কিছু শুকনো খাবার।
মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলীর ছোট ছেলে তরিকুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন ধরেই আমার বাবা অসুস্থ ছিলেন। আমরা এমনিতেই দরিদ্র ও অসহায়। আমাদের বড় ভাই গত দুই বছর আগে মারা যাওয়ায় পরিবারের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়েছে। আমরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ২০১৯ দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর সাহায্যের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তাতেও কোন সাড়া পায়নি। তবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে হয়তো আমাদের এই আবেদনটি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যায়নি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার সোহরাব হোসেন তালুকদার জানান, দুর্গাপুরে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সুচিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছে আরশ আলী। উপজেলার সবচেয়ে প্রত্যন্ত একটা গ্রামে থাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সে নিয়মিত চিকিৎসা করাও তার জন্য অনেক কষ্টের ছিলো। আমরা তার এই করুণ অবস্থা উন্নতি চেয়ে কয়েকবার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সুচিকিৎসার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আরশ আলী কপালে সুচিকিৎসা জোটেনি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজিব উল আহসান জানান, আমি উপজেলায় এসেছি পাঁচ মাসের মত হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলীর অসহায়ত্বের কথা জানায়নি। বিষয়টি আগে জানা থাকলে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
জাগরণ/এমআর