সাকলাইন যোবায়ের
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিদেশগামী ব্যক্তিদের টার্গেট করে করোনা টেস্টের ভুয়া পজেটিভ রিপোর্ট এর কথা বলে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটি চক্র।
বেশকিছু ভূক্তভোগী প্রতারক চক্রকে অর্থ প্রদানের পরেও তাদের করোনা রিপোর্ট পজেটিভ আসার প্রেক্ষিতে তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে প্রতারণার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন।
সাধারণ বিদেশগামী যাত্রী, বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন অফিস ও মিডিয়াকর্মী বিভিন্ন সময়ে র্যাবের নিকট প্রতারাণা সংক্রান্ত লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেন। উক্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং প্রতারকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
র্যাব গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে র্যাব-১১ এর একাধিক আভিযানিক দল প্রথমে কুমিল্লা জেলা কোতয়ালী থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে (১)মো: জসিম উদ্দিন (২২), পিতা- ফয়জুল করিম, দিরাই, সুনামগঞ্জ (২) মো: সুলতান মিয়া (১৯), পিতা মো: মোক্তার আহম্মেদ, নাছির নগর, বি-বাড়িয়াকে গ্রেপ্তার করে।
পরবর্তীতে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও রাজধানী ঢাকার সায়দাবাদ, রমনা ও মতিঝিল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে (৩) মো: বেলাল হোসেনকে (৩১) পিতা মৃত, গোফরান, সেনবাগ নোয়াখালী গ্রেপ্তার করে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার মতিঝিল এলাকা হতে চক্রের সক্রিয় সদস্য (৪) মো: আবুল হোসেন(২৪) পিতা মৃত ইসরাইল মিয়া, (৫) মো: আবদুল নুর (২১) পিতা মো: রফিক মিয়া, (৬) মো: আলফাজ মিয়া (১৯)পিতা মো: আহাদ মিয়া, (৭) মো: শামিম (৩২) পিতা মৃত মো: ফরিদ মিয়া, নাছির নগর বি-বাড়িয়া এবং (৮) মো: আহাম্মদ হোসেন (১৯) পিতা মো: রফিকুল ইসলাম, শ্রী মঙ্গল মৌলভীবাজার, গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল সীমের যোগানদাতা (৯) মো: ইমরান উদ্দিন মিলন (১৯) পিতা আমির হোসেনকে নোয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে বি-বাড়িয়া জেলায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের অন্যতম হোতা (১০) মো: সবুজ মিয়া (২৭) পিতা সুরুত মিয়া, (১১) মো: আব্দুর রশিদ (২৮) পিতা: মৃত আব্দুল বাছের, (১২) আব্দুল করিম চৌধুরী (৩২) পিতা: মো: জজ চৌধুরী, (১৩) মো: আঙ্গুর মিয়া (২৫), পিতা: মো: আদম আলী, আদমপুর, নাছির নগর বি- বাড়িয়া এবং (১৪) মো: আলমগীর হোসেন (২০) পিতা মো: শরিফ মিয়া, মৌলভীবাজার, এদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
উক্ত অভিযানে জব্দ করা হয় প্রায় সাত লক্ষ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০ সীমকার্ড, সিম এ্যক্টিভেট করার ১টি ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, ১টি ট্যাব, ৩২টি মোবাইল, ১টি পাসপোর্ট, নোটবুক এবং চক্রের সদস্যদের বেতনের হিসাব বিবরণী।
প্রতারক চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত বেলাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে মার্চ ২০২১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য কুমিল্লা জেলার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্ট করার পর অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ঐ হাসপাতালের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তার করোনা টেস্টের ফলাফল পজেটিভ এসেছে বলে জানায়। ঐ অজ্ঞাত ব্যক্তি দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলালের করোনা টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ করার প্রতিশ্রুতি দিলে, সে চড়া মূল্যের টিকেট নষ্ট না করে ঐ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে দশ হাজার টাকা প্রদান করে। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে করোনা পজেটিভ ফলাফল প্রেরণ করে। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে ঐ অজ্ঞাত পরিচয়ধারী হাসপাতালে কর্মরত নেই বলে জানতে পারে এবং সে বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে।
তিনি বলেন, পুনরায় এপ্রিল ২০২১ সালে করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসার পর বেলাল ওমানের উদ্দেশ্যে গমণ করে। তবে মার্চ হতে এপ্রিল ২০২১ এই সময়ে বেলাল প্রতারণার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে ব্যাপক বিচার বিশ্লেষণ করে এবং প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশগামী যাত্রীদের নিকট হতে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার রুপ রেখা তৈরী করে। তবে তার বিদেশে যাওয়ার নির্ধারিত তারিখ চলে আসায় সে তার এই পরিকল্পনা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবুজকে অবগত করে। সবুজকে প্রতারণার একটি টিম তৈরী করে দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা সমানভাগে বন্টনের প্রতিশ্রুতিতে সে বিদেশ চলে যায়। সবুজ প্রতারণার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে তবে বেলালকে যে অর্থ প্রেরণ করা হত তা নিয়ে বেলালের সবসময় সংশয় থেকে যায়। এই সংশয় থেকেই মূলত বেলাল ৪ মাস বিদেশে অবস্থান করে ২০২১ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে দেশে চলে আসে।
বেলাল বলেন, এবার সে তার আরেকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জসিমকে এই প্রতারণার কাজে সম্পৃক্ত করে। যেহেতু প্রতারণার এই প্রক্রিয়াটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তাই সে তার মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা সচল রাখার জন্য পুনরায় ডিসেম্বর মাসে বিদেশ যায় এবং জানুয়ারি মাসে প্রতারণার কার্যক্রম চালাতে পুনরায় দেশে চলে আসে।
উল্লেখ্য যে, বেলাল, সবুজ ও জসিম ৪-৫ বছর পূর্বে চট্টগ্রামে একইসাথে ভ্রাম্যমাণ কসমেটিক্স এর ব্যবসা করত। সেই সূত্র ধরেই তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
গ্রেপ্তার আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও বি-বাড়িয়া জেলায়, আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুর রশিদ ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলায়, আব্দুল করিম কুমিল্লা নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আলমগীর সিলেট মৌলভি বাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়, আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা মৌলভিবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় সরকার নির্ধারিত বিদেশগামীদের করোনা টেস্ট হাসপাতালসমূহে সকাল ৭টা হতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান করে এবং অত্যন্ত কৌশলে অন্যান্য সাধারণ যাত্রীদের নম্বরগুলো সংগ্রহ করে।
নম্বরগুলো সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে প্রেরণ করত। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার পূর্বেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা বিভাগের ডাক্তার/হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে ভূক্তভোগীদের নম্বরে কল দিয়ে করোনা টেস্টের ফলাফল পজেটিভ আসছে বলে মিথ্যা তথ্য প্রদান করত। পরে উক্ত পজেটিভ রেজাল্ট নেগেটিভ করে দেয়ার কথা বলে প্রতি ভূক্তভোগীর নিকট থেকে জনপ্রতি মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পাঁচ থেকে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিত।
আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিং এর নাম্বার প্রদান করতো এবং ভূক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজ এর কথা অনুযায়ী ঐ সমস্ত নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা প্রেরণ করলে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান স্বশরীরে উপস্থিত থেকে তা সংগ্রহ করতো।
ভূক্তভোগীর অবস্থান ও টাকা সংগ্রহের অবস্থান সব সময় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় নির্ধারন করা হতো, যাতে কেউ কোন কিছু আঁচ করতে না পারে। আসামিরা একটি সিম একদিন ব্যবহার করে তা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় ব্যবহার করতো এবং কোন নাম্বার নিয়ে সন্দেহ হলে তা ফেলে দিত। প্রতারণার এই পদ্ধতিটি সম্পন্ন করতে মো: মিলন খোলা বাজারের একশত বিশ টাকার সিম ভুয়া রেজিষ্ট্রেশনের মাধ্যমে এক হাজার টাকার বিনিময়ে বেলাল ও সবুজকে প্রদান করতো। তাদের এহেন কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে আসামিরা জানায়।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা কেউ প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডী পার হয়নি। তথাপি অত্যন্ত নিখুতভাবে সুকৌশলে শত শত মোবাইল সিম নামে বেনামে উত্তোলন করে প্রতারণা করে আসছে। প্রতারণার মাধ্যমে মো: সবুজ মিয়া জানায় গত দশ মাসে সে প্রায় হাজারের অধিক বিদেশগামী যাত্রীর নিকট হতে জনপ্রতি ১০-১৫ হাজার করে প্রায় এক কোটি টাকা আয় করেছে এবং উক্ত টাকা দিয়ে সে তার গ্রামের বাড়িতে একটি অট্টালিকা তৈরী করেছে।
অন্যদিকে কাজী মো: বেলাল হোসেন বিদেশ থেকে এসে এই অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ৬ শতাধিক বিদেশগামী যাত্রীদের নিকট হতে জনপ্রতি ১০-১৫ হাজার করে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা আয় করে। বাকি সদস্যরা এই প্রতারণার মাধ্যমে প্রতি মাসে ২৫/৩০ হাজার টাকা আয় করে।
জাগরণ/আরকে