• ঢাকা
  • বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ৩ বৈশাখ ১৪৩২
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২২, ০৪:৩৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২২, ০৪:৩৭ পিএম

সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না হলে ডুবে যাবে সেন্টমার্টিন

সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না হলে ডুবে যাবে সেন্টমার্টিন

দীপন বিশ্বাস
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা পর্যটক সেবার প্রতিশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট, কটেজ আর রেস্তোঁরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই গড়ে ওঠা এসব স্থাপনায় নেই কোনো সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) কিংবা ডাম্পিং স্টেশন। এ অবস্থায় বিশাল জনগোষ্ঠী থেকে নিসৃত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সাগরে। ফলে সাগরের পানি যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। 

সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা এ ঘটনার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেছে সচেতন মহল। এ পরিস্থিতিতে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ইকোট্যুরিজমের উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনাসহ ১৩ সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।

সাগরে বর্জ্য ফেলার কথা স্বীকার করে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, নীতিমালা প্রণয়ন হলে দ্রুত সময়ে সেন্টমার্টিনের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছি।

তথ্য মতে, মাত্র ৮ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন। চারদিকে সাগরবেষ্টিত হওয়ায় শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় ও দর্শণীয় স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে দ্বীপটি। দ্বীপটি সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত। এখানে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। যা পর্যটকদের বাড়তি আগ্রহের জন্ম দেয়। 
প্রতি পর্যটন মৌসুমে ১০টি জাহাজে করে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৫০০ পর্যটক সেন্টমার্টিনে আসা-যাওয়া করেন। পর্যটকদের সেবা দিতে গড়ে উঠেছে ১৮৮টি হোটেল, কটেজ আর রিসোর্ট। আইন অনুযায়ী সেন্টমার্টিনে অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা আমলে নেয়নি কোনো প্রতিষ্ঠান। সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন বা ডাম্পিং ব্যবস্থা না করে ইচ্ছে মতো স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ অবস্থায় পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য এবং পয়ঃ সাগরে ফেলছেন ব্যবসায়ীরা। এসব বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে সাগরের পানি। আর নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। 

১৯৯৯ সালে সরকার সেন্টমার্টিনকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করেও নিয়ন্ত্রণ আনা যায়নি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। উল্টো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বর্ষা মৌসুমে হোটেলের সেফটি ট্যাংকের ময়লা ফেলা হয় সাগরে। আর যত্রতত্র ফেলে রাখা হয় পর্যটকদের অব্যবহার্য জিনিস। 

গবেষকরা বলেছেন, সেন্টমার্টিনের পরিবেশ সুরক্ষা করা না গেলে অচিরেই সাগরে তলিয়ে যেতে পারে দ্বীপটি। এ অবস্থায় সেন্টমার্টিনে সব ধরনের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু শরিফ মো. মাহবুবু-ই-কিবরিয়া বলেন, সেন্টমার্টিন আমাদের সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ কর্তৃপক্ষকে সাগরে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। বর্জ্যের কারণে অতিমাত্রায় দুষিত হচ্ছে সাগরের পানি। এরই মধ্যে গবেষণায় আমরা ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটিয়ার অস্থিত্ব পেয়েছি, যেটির কারণে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সেন্টমার্টিন রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের নির্বাহি প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিনের দ্বীপকে রক্ষা করতে সুপরিকল্পনা দরকার। হোটেল, রিসোর্ট, কটেজসহ সব প্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং স্টক হোল্ডারের সমন্বয় করে হোটেলের নিঃসৃত সব ধরনের বর্জ্য দ্বীপের বাইরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, পানিতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর কোনো জীবাণু পাওয়া গেলে দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু এ ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা নেই।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিনে অবকঠামো নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠান তা আমলে নেয়নি। বরং নিজেদের ইচ্ছে মতো গড়ে তুলেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ দিয়েছে।

হোটেলসহ স্থাপনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই স্বীকার করে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, সেন্টমার্টিনে প্রায় ১৭০ হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁ কোনোটির ছাড়পত্র নেই। সম্প্রতি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করছি আমরা।

তিনি বলেন, সরকার সেন্টমার্টিন রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরকে একটি নীতিমালাও প্রণয়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ে একটি নীতিমালা আসবে।

এদিকে, সেন্টমার্টিনে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, অতীতে কি হয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা করছি না। কীভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সেন্টমার্টিনকে সাজিয়ে তোলা যায় সে ব্যবস্থাই করা হবে। নীতিমালা প্রণয়ন হলে সেই মতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জাগরণ/আরকে