
আকাশ মো. জসিম
নোয়াখালীর সোনাপুরের জিরোপয়েণ্টে স্তুপে স্তুপে রাখা হাজার হাজার তরমুজ। মোবাইল ফোনে বাজারদরের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন বিক্রেতা। ফোন রেখে বলেন, বেশি দামে কিনে এনেছি। কম দামে বেচার সুযোগ নেই।
মৌসুমের শুরু থেকেই তরমুজের দাম চড়া। তবে রমজান আর বৈশাখের খরতাপকে কেন্দ্র করে সবুজ তরমুজেও আগুন লেগেছে। যে আগুনে নিম্মমধ্যবিত্ত তো দূরের কথা, মধ্যবিত্তরাই পুড়ে ছারখার। অথচ দেশজুড়ে চলমান তীব্র তাপদাহে ইফতারের প্রধান উপকরণ হওয়ার কথা তরমুজ।
পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই তরমুজ এখন নোয়াখালী শহরে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই সুযোগে বিক্রেতাদের মুনাফা চরমে। চলতি সপ্তাহে খুচরা বাজারে এক কেজি তরমুজের দাম চলছে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। বেশি ভালো মানেরগুলো ১০০ থেকে ১৮০ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। এতে ৫ কেজির একটি তরমুজের জন্য ক্রেতার গুণতে হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। অথচ এই তরমুজের দাম ১৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। প্রতিটি তরমুজ কমপক্ষে ১০০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।
জেলার ভোক্তা অধিকারের সভাপতি আবদুল মন্নান বলেন, সরকারের যথাযথ বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে করেই বাজারে তরমুজের বাড়তি দাম। এতো ভারী একটি ফল ছোট পরিবারের জন্য কিনতে গেলেও ৫ কেজির নিচে হয় না।
জানা গেছে, এতো দাম হাঁকানো তরমুজের উৎপাদক প্রান্তিক চাষিরা পাইকারি বিক্রেতা বা আড়তদারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি না করার পরেও তরমুজের বাজারে আগুন।
এ বিষয়ে তরমুজের বেশ কয়েকজন তরমুজ চাষি জানিয়েছেন, ক্ষেত থেকে তোলা তরমুজ তারা কেজিতে বিক্রি করছেন না। শ’ হিসেবে বিক্রি করেন বেশিরভাগ চাষি। তবে ভোক্তাদের কাছে এই পণ্য কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জেলার সুবর্ণচরের চরওয়াপদার চরকাজী মোখলেছের চাষি শের আলী বলেন, বর্তমান বাজারে স্থানীয়ভাবে ১০ কেজি ওজনের তরমুজ পাইকারদের কাছে শ’ হিসেবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর নোয়াখালীসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় নিয়ে বিক্রি করলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দরে তরমুজ চলছে।
চরবাটা ইউনিয়নের তরমুজ চাষি তাজুল ইসলাম জানান, আড়তদারদের কাছে ২ কেজি ওজনের তরমুজ সর্বোচ্চ ৮০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন তারা। ১০০ টাকায় যে তরমুজ বিক্রি হয় তার ওজন ৩-৪ কেজি হয়।
একই গ্রামের আরেক তরমুজ চাষী রিয়াজ হোসেনের মুখেও শোনা গেল একই তথ্য। এবার আড়তদারদের কাছে এই দামে তরমুজ বেচেই অনেক লাভবান তারা। সে হিসেবে পরিবহনে উঠিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত ১০ কেজি ওজনের তরমুজের দাম ৫৫০-৬৫০ টাকা, যা শহরে আসার পর হয়ে যাচ্ছে ১০০০ টাকা।
এ বিষয়ে জানা গেছে, সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি লাভবান হতে এমন দর বাড়িয়ে দিয়েছেন। চাষিরা যদি সরাসরি ভোক্তাদের কাছে তরমুজ বিক্রি করতে পারে তাহলে দাম অনেক কম হবে। এমন পরিস্থিতিতে জেলার বিভিন্নমহলে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পরিবারের জন্য প্রিয় ফলটি না কিনতে পেরে হতাশা হয়েছেন অনেকে। মৌসুমি এই ফলটির পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে কেজি দরে তরমুজ বিক্রিকে ভোক্তাদের সঙ্গে বড় রকমের প্রতারণা ও চালবাজি আখ্যায়িত করছেন। কেজি দরে তরমুজ কিনতে চাচ্ছেন না তারা। দামে হতাশ হয়ে কেউ কেউ তরমুজ বয়কটের শ্লোগান দিয়েছেন।
কিন্তু ক্রেতাদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। লকডাউন ও ভালো ফলন না হওয়ার অজুহাত দেখাচ্ছেন তারা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মাইজদী পৌর বাজারের এক তরমুজ ব্যবসায়ী বলেন, এ বছর তরমুজের ফলন ভালো হয়নি। এর ওপর চৈত্রের শুরুতেই প্রচন্ড গরম পড়তে শুরু করায় বেশি দাম পাওয়ার আশায় পরিপক্ক হওয়ার আগেই মাঠ থেকে তরমুজ তুলে বিক্রি করেছেন কৃষকরা।
লকডাউনের কারণে দেশের বেশির ভাগ তরমুজ উৎপাদন হওয়া অন্য জেলা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরমুজ আসতে পারছে না। এজন্য দাম বেশি।
জেলার প্রধান বাণিজ্যিক নগরীর চৌমুহনী বাজারের চিত্রও একই। সেখানেও চলতি সপ্তাহে ১০ কেজি ওজনের একেকটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭শ' থেকে ১০০০ টাকায়। কেজিতে ৮০/৯০ টাকার নিচে পড়ছে না।
দত্তের হাট থেকে ৫ কেজি ওজনের একটি তরমুজ দামাদামি করে ৪৫০ টাকায় কিনেছেন ফারদিন আলম নামের এক ক্রেতা। তিনি বলেন, মৌসুম এলে আমাদের পরিবারের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে তরমুজ। তরমুজ ছাড়া ইফতার কল্পনাও করতে পারে না আমার পরিবার। আজ ৪৫০ টাকায় ৫ কেজি ওজনের একটি কিনলাম। ৯০ টাকা করে পড়েছে। এর চেয়ে বড় কিনলে কেজিতে ১০০ টাকার ওপরে পড়ে যায়।
সোনাপুর বাজারের এক ব্যবসায়ী বললেন, সড়কে চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসায়ীরা বরিশাল ও খুলনা থেকে তরমুজ আনতে পারছে না। যে কারণে মোকামেই প্রতি কেজি তরমুজ ৭০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা কিনতে হচ্ছে আমাদের। সেই তরমুজ ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করাটা দোষের কিছু দেখছেননা তিনি। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।
জানা গেছে, জেলার অন্য উপজেলা শহরেও কেজি দরে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। সেখানে এখন কেজি সর্বনিম্ন ৯০ টাকা কেজি চলছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শহীদুল হক বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তরমুজের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। গতবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে যেসব চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ বছর সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পেরেছেন তারা। ইতোমধ্যে তরমুজ বিক্রি শেষ পর্যায়ে। কমবেশি সব চাষী এবার লাভবান হয়েছেন।
এ বিষয়ে নোয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বক্তব্য, চলতি বছর তরমুজের উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো। জেলার অন্যান্য অঞ্চলেও তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে ।
এ ব্যাপারে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুর রহমান, সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কৃষিপণ্য হিসেবে তরমুজ পরিবহনে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই। কৃষকরা নির্বিঘ্নে তরমুজ বাজারজাত করেছেন। কোনো ধরনের সমস্যা হলে কৃষকদের সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করা হয়। বাজার মনিটরিং এর কথাও বলেন তিনি।
জাগরণ/আরকে