বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানীতে যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল নৌযান। সড়ক পথে ফেরি পারাপারে ভোগান্তির কারণে বেশিরভাগ যাত্রী লঞ্চে যাতায়াত করতেন। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে বিভিন্ন সময় বেড়েছে লঞ্চ ভাড়াও। ভাড়া কমানোর দাবিতে নানা সংগঠন পালন করেছে বিভিন্ন কর্মসূচি। এরপরও ভাড়া কমেনি।
তবে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। সড়ক পথে যাত্রীর চাপ বাড়ায় কমতে শুরু করেছে লঞ্চের যাত্রী। বেশ কয়েকটি লঞ্চ ভাড়া কমিয়েও কাঙিক্ষত যাত্রী পাচ্ছে না। তাই যাত্রী ধরে রাখতে শিগগিরই বৈঠকে বসছেন লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা।
বরিশাল ঢাকা রুটে চলাচলকারী কয়েকটি লঞ্চের সুপারভাইজারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর পর গত কয়েক দিনে ক্রমান্বয়ে কমেছে লঞ্চের যাত্রী। সোমবার (২৭ জনু) রাতে বরিশাল নদী বন্দর থেকে সুরভী-৯, সুন্দরবন-১০, পারাবত ১৮ ও মানামী লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কোনোটিতে ৫০ শতাংশ, কোনোটিতে ৩০ শতাংশ যাত্রী কম ছিল।
শুধু ডেকের যাত্রী কম নয়, ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোর প্রায় অর্ধেক কেবিন খালি গেছে। এভাবে যাত্রী কমতে থাকলে মালিকদের লোকসান গুনতে হবে।
মঙ্গলবার (২৮ জুন) বরিশাল নদী বন্দরে পাঁচটি লঞ্চ নোঙর করা ছিল। রাত সাড়ে ৮টার পর সেগুলো ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। যাত্রী কেমন হয়েছে জানতে চাইলে রাত সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকটি লঞ্চের সুপারভাইজার জানান, যাত্রী সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম।
সুন্দরবন-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘বরিশাল থেকে সোমবার রাতে সুন্দরবন-১০ লঞ্চ ছেড়ে যায়। মঙ্গলবার সকালে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছে। এরপর বিক্রিত টিকিট হিসাব করে দেখা যায় যাত্রী ছিল ৩৪৭ জন। এছাড়া এক তৃতীয়াংশ কেবিন খালি ছিল। সব মিলিয়ে বলা যায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেক যাত্রী ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ডেক যাত্রীদের ভাড়া রাখা হয়েছিল ২০০ টাকা। শুধু সুন্দরবন লঞ্চই নয় বরিশাল থেকে ঢাকায় যাওয়া বাকি তিন লঞ্চের প্রায় একই অবস্থা ছিল।
বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী এমভি মানামী লঞ্চের ব্যবস্থাপক (কাস্টমার সার্ভিস) মো. রিজওয়ান হোসেন রিপন বলেন, ‘লঞ্চ সোমবার রাতে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ছাড়ার আগে দেখা গেছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় শতকরা ৩০ শতাংশ যাত্রী কম উঠেছে। সাধারণত ডেকের যাত্রীরা বিকেল থেকেই লঞ্চে আসতে শুরু করেন। কিন্তু সোমবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও যাত্রী হচ্ছিল না। এ সময় দুটি লঞ্চের স্টাফরা ৩০০ টাকার জায়গায় ২০০ টাকা ভাড়া বলে যাত্রী উঠাতে শুরু করেন। মঙ্গলবারও প্রায় একই অবস্থা ছিল। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় যাত্রী কম যাচ্ছে। বিষয়টি মালিক পক্ষকে জানানো হয়েছে।
বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী কুয়াকাটা লঞ্চ কোম্পানির মালিক আবুল কালাম খান বলেন, ‘সোমবার রাতে কোম্পানির কুয়াকাটা-২ লঞ্চ ঢাকার সদর ঘাট থেকে ছেড়ে গেছে। মঙ্গলবার সকালে যাত্রী নিয়ে সেটি বরিশাল পৌঁছে। ভাড়া কমিয়ে রাখা হয় ২৫০ টাকা। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী যাত্রী ছিল না। লঞ্চটিতে কেবিনে সিট সংখ্যা ২০৭টি। এর মধ্যে ১৪৩ সিট ফাঁকা ছিল। ডেকে যাত্রীও ছিল ধারণ ক্ষমতার অর্ধেকেরও কম। একটি লঞ্চ ঢাকা থেকে বরিশাল আসতে জ্বালানি বাবদ খরচ হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এছাড়া স্টাফদের বেতনও রয়েছে। গত দুদিনে যেভাবে যাত্রী কমছে, তা অনেক মালিকেরই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবুল কালাম খান আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালুর কারণে নৌপথে যাত্রীর আগ্রহ কমছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনার জন্য ২ জুলাই কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির নেতাদের বৈঠক করার কথা রয়েছে। বৈঠকে নৌ-পথে যাত্রী ফেরাতে করণীয় ঠিক করা হবে। কিন্তু কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এদিকে ভাড়া কমায় খুশি লঞ্চ যাত্রীরা। তারা বলছেন, দুই বছর আগেও লঞ্চের ডেকে জনপ্রতি যাত্রী ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। এরপর তা বাড়িয়ে করা হয় ২৫০ টাকা। গত বছর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি হলে এক লাফে জনপ্রতি ডেকভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৩৫০ টাকা। গত ঈদুল ফিতরের আগে আরও ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করা হয়েছিল। বর্ধিত ভাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছিল।
বরিশাল সদর উপজেলার কড়াপুর এলাকার বাসিন্দা মো. এনায়েত হোসেন জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর গত সোমবার সড়ক পথে বাসে পৌনে চার ঘণ্টায় ঢাকায় গেছেন। কাজ সেরে আবার বাসে রাত ৯টার মধ্যে বরিশাল ফিরেছেন। লঞ্চ ভাড়ার চেয়ে বাস ভাড়া সামান্য কিছু বেশি। কিন্তু সময় অনেক কম লাগছে।
বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর বরিশাল-ঢাকা সড়ক পথে উল্লেখযোগ্য হারে যাত্রী বেড়েছে। কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের জটলা থাকছেই। মঙ্গলবারও সাকুরা, ঈগল, হানিফসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস ঢাকা-বরিশাল মিলিয়ে ২০০ এর মতো ট্রিপ দিয়েছে। সব বাস যাত্রীতে পূর্ণ ছিল। যাত্রীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলো আরামদায়ক ও বিলাসবহুল নতুন বাস নামাতে চাইছে। মোট কথা পরিবহন খাতে সুদিন চলছে।
লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন লঞ্চ কোম্পানির মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বরিশাল বিভাগের মানুষের স্বপ্নের শেষ নেই। এ স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের আবেগ। সেতু উদ্বোধন হয়েছে মাত্র তিন দিন আগে। সেই সেতুকে ঘিরে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস থাকবেই। পদ্মা সেতু দেখতে অনেকেই সড়ক পথে ঢাকা যাচ্ছেন। আবার ঢাকা থেকেও সড়ক পথে বরিশাল আসছেন। এ কারণে লঞ্চে যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। তবে দুশ্চিন্তা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মাত্র দুদিন দেখে যাত্রী সংকট তৈরি হবে এটা বলা ঠিক নয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, লঞ্চে যাতায়াতে ঝুঁকি কম, ভ্রমণও আরামদায়ক। লঞ্চের মতো স্বাচ্ছন্দ্য বাসে নেই। বাসের থেকে ভাড়াও কম। আমার বিশ্বাস দু-এক মাসের মধ্যে লঞ্চ আগের মতো যাত্রী পাবে।