জাতিগত বিদ্বেষ ধর্মের অপব্যাখ্যা আর সাম্প্রদায়িকতার বিকৃত চর্চার জেরে বারংবার রক্তাক্ত হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাস। কালচক্রে এই বিকৃতি সবচেয়ে বিভীষিকাময় রূপ ধারন করেছে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে। মানবতা, সম্প্রীতি, শান্তি, সংহতি ও সৃষ্টিশীলতার বাণী নিয়ে কালে কালে পৃথিবীর বুকে আবর্তিত ধর্মতত্ত্বকে স্বার্থপরতায় করা হয়েছে পথভ্রষ্ট। চরমপন্থী ও উগ্রবাদি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিগুলোর বর্বরতায় ঝরে গেছে অজস্র প্রাণ।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ থেকে শ্রীলঙ্কার ম্যালকম চার্চ; বাংলাদেশের ১৭/৮ থেকে ভারতের ২৬/১১' এমন প্রতিটি ঘটনাই ইতিহাসের পাতায় এক একটি নৃশংসতার উপাখ্যানে পরিনত হয়েছে। তবে এই উগ্রবাদীতার নৃশংসতা সবচেয়ে ভয়াল আত্মপ্রকাশ দিয়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর দ্বারা পরিচালিত আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে। বিশেষ করে পৃথিবীর বুকে কাঁপন তোলা সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার মত এক একটি সিরিজ বোমা হামলার নজির অন্তত তাই প্রমাণ করে।
২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো ও এর সংলগ্ন কয়েকটি এলাকায় চারটি হোটেল ও তিনটি গির্জাসহ মোট আটটি স্থানে ভয়াবহ বোমা হামলায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হন। আহত হন প্রায় পাঁচ শতাধিক। সোমবার (২২ এপ্রিল) এ ঘটনার পরদিনও দেশটির কয়েকটি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় ২০ ক্যান উচ্চ মাত্রার বিস্ফোরক, শক্তিশালী ৮৭টি ডেটোনেটর ও টি-৫৬ অস্ত্রের দেড় শতাধিক ম্যাগজিনসহ আরো অস্ত্র। চলমান প্রেক্ষাপটে এ ঘটনাসহ আলোচনা করা যাক বিশ্বের এমনই কয়েকটি সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা নিয়ে।হয়তো এই স্মৃতিচারণে আমাদের বোধের আবর্তন বদলাতেও পারে।
বাংলাদেশের চার শতাধিক স্থানে সিরিজ বোমা: হতাহতের পরিমান উল্লেখযোগ্য না হলেও সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত সিরিজ বোমা হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা। কারণ এক সঙ্গে এতোগুলো স্থানে একযোগে এত ভয়াবহ সিরিজ বিস্ফোরণের অপারেশন পরিচালনার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
এ দিন বেলা ১১টা থে সাড়ে ১১টা এ সময়ের মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার প্রায় ৪৪৩টি স্পটে সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এতে দুজন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এই সিরিজ বোমা হামলার পর জঙ্গিরা যে আলটিমেটাম দিয়েছিল তার ভিত্তিতেই তারা একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলা পরিচালনা করতে থাকে। বিচারক, উকিল ও পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। এই তিন শ্রেণির ওপরই বেশি হামলা করে এবং বেশ কিছু ব্যক্তিকে হতাহত করে তারা।
মুম্বাই বোমা হামলা: রতের মাটিতে পাকিস্তান ভূ-খণ্ডে আশ্রিত উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার সূচনা হয় মূলত ১৯৯৩ সালের মুম্বাই হামলার মধ্য দিয়ে। সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানের নামও সর্বপ্রথম শোনা যায় এই বোমা হামলায়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দায়ে ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ ভারতের ব্যস্ততম নগরী মুম্বাইসহ মোট ১৩টি স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এ হামলায়। ভয়াবহ এই সিরিজ বোমা হামলায় কমপক্ষে ২৫৭ জন ও প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হন। এই হামলার সাথে সম্পৃক্ততা ও ভারতে অবৈধ মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার দায়ে প্রকাশিত দেশটির মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি তালিকায় তখন উঠে আসে হামলার মূল হোতা দাউদ ইব্রাহিমের নাম। ভারতের দাবি, পাকিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে এই এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন দাউদ। আর তার সহযোগী হিসেবে নাম আসে টাইগার মেমন ও ইয়াকুব মেমনের।
ভারতের মহারাষ্ট্র রেল স্টেশন বোমা হামলা: ২০০৬ সালে ১১ জুলাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাই-এর সুবরবন রেলওয়ে স্টেশনে পরিচালিত জঙ্গি হামলাটি সুদীর্ঘ সময়ের জন্য এক জীবন্ত আতংকের মতো মানুষের মনে ঠাঁই করে নেয়। এদিন মাত্র ১১ মিনিট সময়ের মধ্যে ৭টি ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় মুম্বাই শহর। জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সদস্য, ভারতের বিন লাদেন হিসেবে পরিচিত আবদুল সুবাহান কুরেশি এই হামলার বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। এই হামলায় অন্তত ২০৯ জন নিহত ও প্রায় ৭০০ মানুষ বীভৎসভাবে আহত হন।
ফের হামলা, ফের মুম্বাই: তবে ভারতের বুকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলাটি হয় ফের সেই যেখান থেকে শুরু সেখানেই। ঘটনাস্থল এবারও সেই মুম্বাই, সাল ২০০৮। পাক মদদপুষ্ট লস্কর-ই-তৈয়বা নামের জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষিত ১০ জন সশস্ত্র সদস্য জলপথে ভারতে প্রবেশ করে এই হামলা পরিচালনার কাজে। টানা ৪ দিন ধরে চলে জঙ্গিদের নৃশংস তাণ্ডব! জঙ্গিরা নগরীর হোটেল ওবেরয় ও হোটেল তাজের ভেতর প্রবেশ করে বিদেশি পর্যটকসহ সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাশাপাশি তারা নগরীর 'নরিম্যান হাউজ' নামের একটি ইহুদি কলোনি, 'ছত্রপতি শিবাজী' টার্মোলেন, মুম্বাই মেট্রো সিনেমা হল, সেন্ট জাভিয়ার স্কুল লেনসহ পৃথক পৃথক ৮টি স্থানে বোমা বিস্ফোরন ঘটায় ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এ হামলায় বিদেশিসহ কমপক্ষে ১৭৪ জন এই হত্যাকাণ্ডে শিকার হন। জঙ্গিদের প্রধান হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদের পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় ভারতের ইতিহাসে ২৬/১১ মুম্বাই ট্র্যাজেডি হিসেবে আখ্যায়িত এই ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। জঙ্গি সংগঠনটির অন্যতম নেতা জাকি-উর-রেহমান লাখভি, বর্তমানে সংগঠনটির কাশ্মীরের সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে কাজ করছেন। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাই হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনিও।
লন্ডনে সিরিজ বোমা হামলা: ২০০৫ সালের ৭ জুলাই মধ্য লন্ডনের তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হন ৫২ জন। আহত হন সাত শতাধিক মানুষ। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে লন্ডনের রাসেল স্কয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশনে প্রথম হামলা চালানো হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে এজওয়ার ও অ্যাল্ডগেটে পৃথক দুটি হামলায় যথাক্রমে ছয় ও সাত জন নিহত হন। এর প্রায় একঘণ্টা পর তাভিস্টক স্কয়ারে একটি দ্বিতল বাসে বোমা হামলা চালানো হয়। জানা যায়, বোমা হামলাকারী চার জঙ্গির সঙ্গে চরমপন্থি সংগঠন আল কায়েদার সংযোগ ছিল।
ইরাকে বোমা হামলা: ইরাকের ইয়াজিদী এবং জাজিরা শহরে যুক্তরাজ্যের আধিপত্য থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালের আগস্টের ১৪ তারিখ পর পর চারটি আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলা করা হয়। তিনটি গাড়ি এবং একটি তেলের ট্যাংকার প্রায় দুই টনের মত বিস্ফোরক বহন করছিল। এ হামলায় ৭৯৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৫৬২ জন আহত হন। এ বোমা বিস্ফোরণে ভবনসহ চারপাশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধারণা করা হয়, ইরাকের আল কায়দা এ হামলা করে।
প্যারিসে আত্মঘাতী হামলা: ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় ফ্রান্সের প্যারিস ও সেন্ট-ডেনিসে ধারাবাহিক ও সমন্বিত সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়। ফ্রান্সের বাইরে তিনটি আলাদা আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং প্যারিসের কাছাকাছি চারটি ভিন্ন স্থানে গণহত্যা ও আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এ হামলায় অন্তত ১২৮ জন নিহত হন। আহত ৪১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এতে সাত আক্রমণকারীও মারা যায়।
এসজেড