
জি কে বিল্ডার্সের মালিক এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। নিজেকে তিনি যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। একসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ক্যাডার ছিলেন জি কে শামীম। বিএনপি আমলে জি কে শামীমের ভয়ে রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, শান্তিনগরের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি ছিল তার পেশা। সেসময় মির্জা আব্বাসের ডান হাত হিসেবে গণপূর্ত ভবনের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওসারের ডান হাত বলে পরিচিত শামীম ঢাকা মহানগরের টেন্ডারের নিয়ন্ত্রক। এ কারণে অনেকের কাছে ‘টেন্ডার শামীম’ বলেও পরিচিত।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও তিনি আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে বহাল তবিয়তে গণপূর্ত ভবন নিয়ন্ত্রণ করতেন। জীবনের ভয়ে আওয়ামী লীগের অনেক ঠিকাদার ওই ভবন ছেড়ে পালান। বাংলাদেশের সব ঠিকাদারকে গণপূর্তে কাজ করতে হলে তাকে জানিয়ে কাজ করতে হতো। বাংলাদেশের প্রথম সারির (১-২০) সকল ঠিকাদার বাইরে তার ভয়ে কথা বলার সাহস পান না। এক অর্থে বলা যায়, অলিখিতভাবে গণপূর্ত ভবনের মালিকই ছিলেন তিনি।
এরপর কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা পরিচয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সারা বাংলাদেশের কনস্ট্রাকশনের যত বড় বড় কাজ হয়, এর সব তার নির্বাচিত ঠিকাদরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ করতে পারেন না। যদি কেউ জি কে শামীমকে না জানিয়ে দরপত্র কেনেন তবে তার পরিনাম হয় ভয়ঙ্কর। ওই প্রতিষ্ঠানে তার অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী শুধু হামলাই করবে না, প্রয়োজনে তাদের মেরেও ফেলতে পারে।
আজ শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টা থেকে জি কে শামীমের নিকেতনের ডি ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ১৪৪ নম্বর বাসা ঘিরে ফেলে র্যাব। এর আগে নিকেতন এলাকায় জি কে শামীমের আরেকটি বাসা থেকে তাকে ডেকে আনা হয়। পরে তাকে ৭ বডিগার্ডসহ আটক করেই অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, প্রায় দুশ কোটি টাকার এফডিআর, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতারের পর জি কে শামীমের নাম আলোচনায় উঠে আসে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, খাটো গড়নের মানুষ হলেও জি কে শামীমের ক্ষমতার দাপট ছিল আকাশসমান। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যুবলীগের পার্টি অফিস, বিয়ে বাড়ি কিংবা বন্ধুর বাড়ি- যেখানেই তিনি যান, সঙ্গে থাকে অস্ত্রধারী দেহরক্ষী। তাদের একেকজনের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। সবার হাতেই থাকে শটগান। তারা জি কে শামীমের সামনে-পেছনে থেকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যান।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন জি কে শামীম। বাসাবো এলাকায় তার পাঁচটি বাড়ি এবং একাধিক প্লট রয়েছে। বাসাবোর কদমতলায় ১৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটি জি কে শামীমের। বাড়ির ম্যানেজার হিসেবে দেখাশোনা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইসমাইল হোসেন সর্দার। শামীম কয়েক বছর বাসাবোর ওই বাড়িতে বসবাস করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিন ছেলের মধ্যে জি কে শামীম মেঝো। বড় ছেলে গোলাম হাবিব নাসিম ঢাকায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেন।
সন্মানদী ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুল পাস করার পর তাদের গ্রামে দেখা যায়নি। ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন শামীম।এছাড়া বাসাবোতে আরও রয়েছে তিনটি ভবন এবং ডেমরা ও দক্ষিণগাঁও ছাড়াও সোনারগাঁ উপজেলা, বান্দরবান ও গাজীপুরে কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি।
বাসাবো ও এজিবি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর এজিবি কলোনি, হাসপাতাল জোন এবং মধ্য বাসাবোতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শামীম। ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের মাধ্যমেই তার রাজনীতি শুরু। পরবর্তী সময়ে মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা কালু ও মির্জা খোকনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন।
ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদকের পদও পেয়েছেন। বিএনপি আমলে গণপূর্ত ভবন ছিল তার দখলে। একসময় মির্জা আব্বাস আর খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবিসহ সবুজবাগ-বাসাবোসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শোভা পেত জি কে শামীমের ব্যানার-পোস্টার। এখন সেখানে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবিসহ পোস্টার-ব্যানার।
তবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর জানায়, জি কে শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো পদে নেই। অনুমোদিত কমিটির কোথাও জি কে শামীমের নাম নেই। কেউ যদি মুখে মুখে নিজেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বলে থাকেন সেটা তো হবে না।
যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলু দৈনিক জাগরণকে বলেন, যুবলীগে জিকে শামীমের কোনো পদ নেই। উনার যদি যুবলীগে পদ থাকত তাহলে তো ‘না’ করতে পারতাম না। তিনি জানান, যুবদলের সাবেক সহ-সম্পাদক জিকে শামীম বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে আছেন। মূল কমিটি অনুমোদনের পর বেশ কয়েকজনকে সহ-সম্পাদক থেকে শুরু অনেক পদই দেয়া হয়েছে। আর আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক এস এম মেজবাহ হোসেন বুরুজ ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর মারা যাওয়ার পর শূন্য পদটি দেয়া হয়েছে জি কে শামীমকে। শামীম ওই পদ ব্যবহার করে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।
এএইচএস/ এইচ এম/ এফসি