১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতে সন্ত্রাসী হামলায় ৪৬ জন আধা-সামরিক পুলিশ বাহিনীর সদস্য (সিআরপিএফ) হতাহতের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে পাকিস্তানকে। যদিও দেশটি জোর গলায় এই সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেই যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘জঈশ-ই-মহম্মদ’ যখন হামলার দায় স্বীকার করে নেয়, তখন কোনোভাবেই পাকিস্তান এই হামলার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
সম্প্রতি কাশ্মীরের পুলাওয়ামায় জঙ্গবাদী বোমা হামলায় বিধ্বস্ত সিআরএফ কনভয়
ভারতের অনেকবারই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তবে বলার মতো বড় সন্ত্রাসী হামলার শুরু ১৯৮০ সালে। অবশ্য সেই দশকের সন্ত্রাসী হামলাগুলোর বেশিরভাগই ছিল শিখদের স্বাধীন খালিস্তান দাবির প্রেক্ষিতে। এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলাও আছে কয়েকটি।
তবে ২০০০ সালে ডিসেম্বর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। ২২ ডিসেম্বর দিল্লির বিখ্যাত লাল কেল্লায় হামলা চালায় পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা। নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন তিন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। সেটাই প্রথম পাকিস্তানের অভ্যন্তরের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সরাসরি ভারতে হামলায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে। যথারীতি পাকিস্তান কোনো দায় স্বীকার করেনি। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় সন্ত্রাসী দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারত থেকে বারবার বলা হলেও পাকিস্তান সেই সংগঠনটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
১৯৯৩ সালের জঙ্গিবাদী বোমা হামলার একটি দৃশ্য (ফাইল ফটো)
ভারতের মাটিতে পাকিস্তান ভূ-খণ্ডে আশ্রিত উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার সূচনা হয় মূলত ১৯৯৩ সালের মুম্বাই হামলার মধ্য দিয়ে। সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানের নামও সর্বপ্রথম শোনা যায় এই বোমা হামলায়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দায়ে ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ ভারতের ব্যস্ততম নগরী মুম্বাইসহ মোট ১৩টি স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এ হামলায়। ভয়াবহ এই সিরিজ বোমা হামলায় কমপক্ষে ২৫৭ জন ও প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হন। এই হামলার সাথে সম্পৃক্ততা ও ভারতে অবৈধ মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার দায়ে প্রকাশিত দেশটির মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি তালিকায় তখন উঠে আসে হামলার মূল হোতা দাউদ ইব্রাহিমের নাম। ভারতের দাবি, পাকিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে এই এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন দাউদ। আর তার সহযোগী হিসেবে নাম আসে টাইগার মেমন ও ইয়াকুব মেমনের।
দ্বিতীয় দফায় উগ্রবাদী জঙ্গি হামলার স্বীকার হয় ভারতীয় সংসদ ভবন। ২০০১ সালের এই হামলার মধ্য দিয়েই দেশটির বিরুদ্ধে একযোগে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় পাক-অধ্যুষিত ভূ-খণ্ডে লালিত সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জঈশ-ই-মহম্মদ। সংগঠন দুটি যৌথভাবে আলোচিত এই হামলা চালায় যাতে একজন সাধারণ নাগরিকসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়। মূলত এই হামলার মধ্য দিয়েই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। হামলার মূল হোতা ছিলেন সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন জঈশ-ই-মহম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহার। যদিও আফগানিস্তানের কান্দাহারে ভারতীয় বিমান অপহরণের ঘটনায় তাকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন ভারত সরকার। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবেই স্বীকৃত এই জঙ্গি নেতাকে সাজা দিতে ব্যর্থ হয় সেদেশের সরকার। সম্প্রতি সেই জঈশ নেতার হাত ধরে পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় জওয়ানদের রক্তে ফের রক্তাত্ত হলো ভারতের মাটি!
২০০৮ সালের ২৬/১১ সন্ত্রাসী হামলার সময় জ্বলছে হোটেল তাজ (ফাইল ফটো)
২০০৬ সালে ১১ জুলাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাই-এর সুবরবন রেলওয়ে স্টেশনে পরিচালিত জঙ্গি হামলাটি সুদীর্ঘ সময়ের জন্য এক জীবন্ত আতংকের মতো মানুষের মনে ঠাঁই করে নেয়। এদিন মাত্র ১১ মিনিট সময়ের মধ্যে ৭টি ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় মুম্বাই শহর। জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সদস্য, ভারতের বিন লাদেন হিসেবে পরিচিত আবদুল সুবাহান কুরেশি এই হামলার বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। এই হামলায় অন্তত ২০৯ জন নিহত ও প্রায় ৭০০ মানুষ বীভৎসভাবে আহত হন।
তবে ভারতের বুকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলাটি হয় ফের সেই যেখান থেকে শুরু সেখানেই। ঘটনাস্থল এবারও সেই মুম্বাই, সাল ২০০৮। পাক মদদপুষ্ট লস্কর-ই-তৈয়বা নামের জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষিত ১০ জন সশস্ত্র সদস্য জলপথে ভারতে প্রবেশ করে এই হামলা পরিচালনার কাজে। টানা ৪ দিন ধরে চলে জঙ্গিদের নৃশংস তাণ্ডব! জঙ্গিরা নগরীর হোটেল ওবেরয় ও হোটেল তাজের ভেতর প্রবেশ করে বিদেশি পর্যটকসহ সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাশাপাশি তারা নগরীর 'নরিম্যান হাউজ' নামের একটি ইহুদি কলোনি, 'ছত্রপতি শিবাজী' টার্মোলেন, মুম্বাই মেট্রো সিনেমা হল, সেন্ট জাভিয়ার স্কুল লেনসহ পৃথক পৃথক ৮টি স্থানে বোমা বিস্ফোরন ঘটায় ও নির্বিচারে মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ হামলায় বিদেশিসহ কমপক্ষে ১৭৪ জন এই হত্যাকাণ্ডে শিকার হন। জঙ্গিদের প্রধান হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদের পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় ভারতের ইতিহাসে ২৬/১১ মুম্বাই ট্র্যাজেডি হিসেবে আখ্যায়িত এই ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। জঙ্গি সংগঠনটির অন্যতম নেতা জাকি-উর-রেহমান লাখভি, বর্তমানে সংগঠনটির কাশ্মীরের সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে কাজ করছেন। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাই হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনিও।
প্রকাশ্য এ সকল সত্য অবগত থাকার পরেও স্বীকৃত জঈশ-ই-মহম্মদের প্রধান নেতা মাওলানা মাসুদ আজহারকে কান্দাহার ঘটনায় সাজা দিতে ব্যর্থ হয় পাক-সরকার। নির্বিঘ্নে দেশটির সুপরিচিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এই জঙ্গি নেতা, যেখান থেকে নিজের ভাগ্নের রক্তের বদলা নিতেই পুলাওয়ামার মাটিতে চালানো হলো আত্মঘাতী বোমা হামলা। অপরদিকে ২৬/১১ মুম্বাই হামলার মূলহোতা লস্কর-ই-তৈয়বা প্রধান হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদকে পাকিস্তানের মাটিতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় ২০১৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনেও তাকে মনোনয়ন দেয়া হয় অংশগ্রহণের। তখন কোনোভাবেই বর্বর এই মানবতা বিরোধী জঙ্গিবাদ তত্ত্বের প্রতি পাক-প্রীতি আর গোপন থাকার অবকাশ নেই। বিশিষ্টজনদের মতে এমন প্রকাশিত জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের প্রতি পাক-সরকারের 'সুদৃষ্টিই' এর মূলকারণ, যা স্পষ্টতই দেশটির পক্ষ থেকে জঙ্গি মদদের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
২০০৬ সালের সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত সুবরবন রেলস্টেশনের বাইরের একটি দৃশ্য (ফাইল ফটো)
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান সাঈদ সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জঙ্গি ঘাঁটি থেকে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে সংগঠনটি। কাশ্মীরে অশান্তি ছড়ানোর দায়ে ২০১১ সাল থেকে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
এ সকল হামলার পাশাপাশি ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে ভারতের বিরুদ্ধে পাক-পুষ্ট জঙ্গিদের চলমান তৎপরতার বিষয়ে খবর হওয়া যায়। দেশটির সীমান্তবর্তী সেনা ঘাঁটিগুলোতে এই লাগাতার জঙ্গি হামলায় অতিষ্ঠ হয়েই গত বছর পাকিস্তানের ভূ-খণ্ডে স্থাপিত জঙ্গি ঘাটির ওপর ‘অপারেশন সার্জিকাল স্ট্রাইক’ পরিচালনায় বাধ্য হয় ভারতীয় সেনা-কমান্ডো।
যথারীতি পাকিস্তান এ সকল ক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও তদন্তে বের হয়ে আসে আসল সত্য। এই হামলার সঙ্গে শুধু জড়িত বললে অনেক কম বলা হয়। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র, বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজনীয় আরডিএক্স এবং এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রশিক্ষণ- সবই পাক্স্তিান থেকে নিয়ে এসেছিল সন্ত্রাসীরা।
এসজেড/এস_খান/এসএমএম