• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০১৯, ০৯:৫৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৯, ২০১৯, ০৯:৫৬ পিএম

ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ করছেন নীতি-নির্ধারকরা

ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ করছেন নীতি-নির্ধারকরা

উপেক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
অদ্যবধি কার্যকর হচ্ছে না সিঙ্গেল ডিজিট
হু হু করে বাড়ছে সুদহার

দেশের ব্যাংক খাতের সুদহার নিয়ে চলছে লুকোচুরি। প্রকাশ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের নির্দেশ অমান্য না করলেও ব্যাংকের নীতি-নির্ধারকের ফোরাম থেকে ১৫ শতাংশে নিচে ঋণ বিতরণ না করতে অলিখিত নির্দেশনা দেয়া আছে। যার কারণে প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশনার পরও ব্যাংকের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামছে না। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, তারল্য সংকটের কারণেই বাড়ছে ঋণের সুদহার। যদিও তারল্য সংকটের আগে তারা বলেছিলেন আমানত পাচ্ছেন না। মূলত সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের সুদহার মেনে চলছে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দেশে ব্যবসারত ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে গত মে মাস শেষে ৩১ ব্যাংকের ঋণের সুদহার দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে। বাকি অধিকাংশ ব্যাংকেই দুই অঙ্ক ছুঁই ছুঁই। তবে একক ঋণ হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষ কোনো কোনো ব্যাংকের সুদহার সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আর ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে রয়েছে ৩১ ব্যাংকের। এর মধ্যে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ঋণের সুদহার ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ১০ দশমিক ১১ শতাংশ এবং ব্যাংক আল ফালাহ ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ, আইএফআইসি ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ইস্টার্নে ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ, এনসিসির ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, সাউথ ইস্ট ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ, ডাচ্-বাংলায় ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ডে ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, এক্সিমের ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ, প্রিমিয়ারে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যমুনা ব্যাংকের ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, এনআরবি কমাশিয়াল ব্যাংক ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মেঘনা ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ, পদ্ম ব্যাংক (সাবেক ফামার্স ব্যাংক) ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এরআরবি গ্লোবাল ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ ও মধুমতি ব্যাংক ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, গত ২০ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়, যেসব ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারবে না, ওই সব ব্যাংকের সরকারি আমানত রাখা হবে না। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীও একাধিকবার সুদহার কমিয়ে আনতে বলেছেন। পরবর্তীতে গত ১৪ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাংকের যে সমস্যাটা, আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। আর এ সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার জন্য আমরা কতকগুলো সুবিধাও দিলাম। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটা মানেনি। এবারের বাজেটে সেটা বলাই আছে, নির্দেশনাও আছে। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের এ নিয়মটা মেনে চলতে হবে যেন ঋণটা সিঙ্গেল ডিজিটে হয়। কোনোমতেই যেন ডাবল ডিজিটে না যায়।

ব্যাংকাররা বলছেন, তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকের সুদহার কমছে না। এছাড়া সরকার যদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে দেয়, তাহলে ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব। তবে চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগে এবং বর্তমান সময়ে সরকার ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দিয়েছেন। তবুও আমানতের সংকটের কারণে কমছে না সুদহার। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন নির্বাহী দৈনিক জাগরণকে বলেন, সরকার যদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার না কমায় তাহলে ব্যাংকগুলো কীভাবে ঋণের সুদহার কমাবে। কারণ গ্রাহকের থেকে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। আর আমানত সংগ্রহ না থাকলে যেমন তারল্য সংকট বাড়বে তেমনি বাড়বে ঋণের সুদহার। সরকারকে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। 

নাম-পরিচয় গোপন করে গ্রাহক পরিচয়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বেশ কয়টি শাখায় যোগাযোগ করলে তারা ‘১৪ শতাংশের নিচে ঋণ দেয়া যাবে না’ বলে সাফ জানিয়ে দেন।

জানা গেছে, বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে সরকারি তহবিলের ৫০ ভাগ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার নির্দেশনা দেয় সরকার। আগে এ হার ছিল ২৫ ভাগ। অর্থাৎ সরকারি তহবিলের অর্থ ৭৫ ভাগ থাকত সরকারি ব্যাংকে এবং বাকি ২৫ ভাগ রাখা যেত বেসরকারি ব্যাংকে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা এবং এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বর্ধিত করা হয়েছে। এরপরও ঋণের সুদহার কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র আরো জানায়, তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপকে কেন্দ্র করে সুদহার বাড়তে থাকায় তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৩০ মে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রকার ঋণের সুদহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে। ঋণের সুদহার অযৌক্তিক মাত্রায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। তাই সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্প্রেড ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আগে যা ৫ শতাংশ ছিল।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন দৈনিক জাগরণকে বলেন, বেশ কিছু কারণে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমছে না। একে তো ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট, অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের চড়া সুদের কারণে আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। আর বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। যার কারণে ব্যাংকের সুদহার বেড়েই চলছে। 

ব্যাংকের নীতি-নির্ধারকরা কীভাবে ১৪ শতাংশের নিচে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেন- এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কোনো নীতি-নির্ধারক এমন বললেই তো আর কার্যকর হবে না। অন্য ব্যাংক যদি আরো কমে ঋণ বিতরণ করে, গ্রাহক তার কাছেই যাবে। ব্যাংক ঋণের সুদহার কমাতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারলেই সুদহার কমে যাবে। 

এআই/ এফসি

আরও পড়ুন