‘‘চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের নির্মাণ, গতানুগতিক ও বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পই চীনা কোম্পানিগুলো বাস্তবায়ন করছে’’
.........................
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা ব্যবসায়ীদের দেশটির সঙ্গে ব্যবসা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের সকল সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে তাই আমি আপনাদের বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা এবং বাণিজ্য সম্পর্কের সকল সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগানোর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যায় চায়না কাউন্সিল ফর দি প্রোমোশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড (সিসিপিআইটি)-এ চীনা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে তার মূল প্রবন্ধে এ কথা বলেন।
সিসিপিআইটি চেয়ারপারসর গেও ইয়ান গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তৃতা করেন।
বাংলাদেশের রফতানি খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, আগামী বছরগুলোতে চীনের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করবেন।
তিনি বলেন, এখন এমন অনেক ক্ষেত্রই রয়েছে যেখানে আপনাদের বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করতে পারেন। বিশেষকরে উৎপাদন খাতে-যেমন বস্ত্র ও চামড়া এবং মাঝারি ও ভারি শিল্প খাত যেমন কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং হাল্কা প্রকৌশল খাতে।
চীন এরইমধ্যে বাংলাদেশের বৃহৎ ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দুই দেশের মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার একটি বড় অংশই ছিল চীন থেকে আমদানি নির্ভর।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ চীনের অত্যন্ত নিকট প্রতিবেশি এবং ভূ-কৌশলগতভাবে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মাঝে অবস্থিত। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে ৮ম বৃহত্তম দেশ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার বিশাল বাজারে কেবল সরাসরি প্রবেশাধিকারই নিশ্চিত করবে না বরং পরোক্ষভাবে চীন তথা দক্ষিণ এশিয়ার ৩শ’ কোটির অধিক জনসংখ্যার বাজারেও প্রবেশাধিকার প্রদান করবে।
এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন বড় বাজারগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে যদিও দেশটি একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন লাভ করেছে।
বাংলাদেশকে একটি কঠোর পরিশ্রমী, দক্ষ এবং স্বল্প শ্রমব্যয়ের দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ স্বল্প দক্ষ এবং ম্যানেজমেন্ট গ্রেড শ্রমিকদের বেতন-ভাতা এদেশেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাইতে স্বল্পতম।
‘‘ বিডা ও বেজার মতো বাংলাদেশী বিনিয়োগ সম্প্রসারণকারী সংস্থাগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্রস্তাব দিয়েছে’’
.........................
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নানারকম প্রতিযোগিতামূলক এবং আকর্ষণীয় আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজও প্রদান করে থাকে।
যার মধ্যে রয়েছে- যখন ইচ্ছে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাওয়ার সময় মুনাফা এবং আসল নিয়ে যাওয়ার সুযোগ, আয়কর রেয়াত, নির্ধারিত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা, ৭৫ হাজার ডলার বিনিযোগের ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ এবং ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নাগরিকত্বও প্রদান করে থাকে।
তিনি বলেন, তৈরি পোশাক এবং বস্ত্র খাতে চীনের পর পরই বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানিকারক দেশ এবং এই তৈরি পোষাক খাতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের অপার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের উচ্চমান এবং দামের সুবিধার জন্য এটি এরইমধ্যে বিশ্বের মোট রফতানির ২ থেকে ৩ ভাগ দখলে সমর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বৃহৎ অর্থনীতির দেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই তথ্য প্রযুক্তি এবং তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত সেবাসমূহ রফতানি করছি। দেশের প্রথাগত জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প-কারখানাগুলোকে জাহাজ নির্মাণ শিল্প কারখানায় রূপান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নত অনেক দেশেই ছোট এবং মাঝারি আকারের জাহাজ রফতানি করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান আইনি সনদ অনুযায়ী (ট্রিপ-টিআরআইপি) আন্তর্জাতিক মেধাসত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে সাধারণ ওষুধ সামগ্রী রফতানি করছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং চীন রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা একটি বিশেষ একটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট পার্ক (এপিআই) প্রতিষ্ঠা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির মাছ ও শাক-সবজি উৎপাদনকারী ও চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশে ৩৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য ও সেবা রফতানি করেছে। ‘২০২৩-২৪ সাল নাগাদ আমাদের রফতানির পরিমাণ ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, দ্রুত শিল্পয়ানের লক্ষে সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে এবং দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতে অন্তত একটি করে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করছে।
‘‘বাংলাদেশ এখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এ পরিণত হতে সঠিক পথেই এগোচ্ছে। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ওই বছর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে’’
.........................
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চীনা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে এবং এজন্যই চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশটিতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে। অধিকন্তু বিডা ও বেজার মতো বাংলাদেশী বিনিয়োগ সম্প্রসারণকারী সংস্থাগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্রস্তাব দিয়েছে।
তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের নির্মাণ, গতানুগতিক ও বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পই চীনা কোম্পানিগুলো বাস্তবায়ন করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে এখন ‘অভূতপূর্ব’ উন্নয়নের দেশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে এবং দেশটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ টানা চার বছর ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছর আমরা ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার অর্জন করেছি। এটা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হার। অব্যাহত উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের সামাজিক খাতগুলোতে এই উল্লেখযোগ্য অর্জনের প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)’র অধিকাংশই অর্জন করেছি এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ সুগম করে ফেলেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এ পরিণত হতে সঠিক পথেই এগোচ্ছে। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ওই বছর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়া আমাদের লক্ষ্য।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ম্যাককিনসেই অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশকে গন্তব্যের পথে অন্যতম দ্রুত বিকাশমান দেশ, উদীয়মান পণ্য উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র এবং সম্প্রসারিত ভোক্তা অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস’র এক রিপোর্টে ২০৫০ সালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী শীর্ষ ৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে তালিকাভুক্ত করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রিপোর্টে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পিপিপি’র মান অনুযায়ী ৩ দশমিক শূন্য ছয় চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপিসহ ২৩তম অবস্থানে স্থান দেয়া হয়েছে।
গোলটেবিল বৈঠকে চীনা ইণ্টারন্যাশনাল কন্ট্রাকটরস অ্যাসোসিয়েশনের (সিএইচআইএনকেএ) চেয়ারম্যান ফ্যাঙ্ক কুইচেন, চীনা স্টেট কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (সিএসসিইসি) ঝুউ ইয়ং, হাওয়াই টেকনোলজির নির্বাহী ভাইচ প্রেসিডেন্ট জেঙ্গ চেঙ্গগেঙ্গ, হায়ার ইলেকিট্রকেল এপ্লিয়ান্স এর ভাইচ প্রেসিডেন্ট ডিয়াও ইয়ুনফেঙ্গ, চীনা রেলওয়েস ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ কোম্পানির চেয়ারম্যান জিএএন বেইশিয়ান ও ওভারসিস অপারেশনস অব চীনা রেলওয়ে কন্সট্রাকশন গ্রুপের প্রেসিডেন্ট কেও বাওগেঙ্গ বক্তব্য রাখেন।
বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট ফজলে ফাহিম, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মুনতাকিম আশরাফ, ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট রোকেয়া আফজল রহমান।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
গোলটেবিল বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চীনের বাণিজ্য নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এতে অংশগ্রহণে তাদের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন।
তারা টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফেকচারিং ও কন্সট্রাকশন সেক্টরের মত গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টরে বিনিয়োগ করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ চীনা কোম্পানি কাজ করছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকের গোলটেবিল বৈঠকে ২৬টি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করে।
পরে সিসিপিআইটি’র চেয়ারপারসর গাও ইয়ান সিসিপিআইটি সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন।বাসস
এসএমএম