সরকার নির্ধারিত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে দেশব্যাপী বহুসংখ্যক কারখানা খোলা রাখার সত্যতা পাওয়া গেছে। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের পাঁচ শতাধিক কর্মী কাজ করছেন ব্রিটানিয়া গার্মেন্টস প্যাকেজিং ও ট্যাগ প্যাকেজিং কারখানায়। সরকারের নির্দেশ অমান্য করে সোমবার (২৬ জুলাই) গোপনে কারখানা খোলা রাখা হয়। এ খবর পেয়ে সিংগাইরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লার নেতৃত্ব একটি টিম গার্মেন্টসটি বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠান দুটির এমডি জহির আহম্মদ ও চেয়ারম্যান জামিল আহম্মদ।
একই দিন ঢাকার অদূরে সাভার এলাকায় অবস্থিত বিজিএমইএমইএ’র সদস্যভুক্ত কারখানা ডায়নামিক সোয়েটার লিমিটেডে কার্যক্রম চালু ছিল। প্রতিষ্ঠানটিতে দুই হাজার শ্রমিক রয়েছে। সোমবার একটি শিফটে কারখানাটিতে ১০০ শ্রমিক কাজ করছিল।
খবর পেয়ে সাভারের স্থানীয় প্রশাসনের একটি টিম কারখানায় গিয়ে সত্যতা পায়। স্থানীয় পুলিশ কারখানার ডিজিএম মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, পিডি জুয়েল কবির এবং এইচআর কম্প্লায়েন্স অফিসার মারুফ হাসানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। কারখানা আর খোলা হবে না মুচলেকা দিলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক (সাধারণ) মো. এনামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে খবর আসে কারখানাটি খোলা রয়েছে। খবর পাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে কারখানায় পৌঁছাই। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কারখানাটি বন্ধ করেছি।
তিনি বলেন, কারখানার কর্মকর্তা মুচলেকা দিয়েছে, সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে আর কারখানা আর খুলবে না।
তার আগের দিন রোববার (২৫ জুলাই) কারখানা চালু রাখায় বিজিএমইএর সদস্য কারখানা আলিম নিটওয়্যার লিমিটেডকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারখানাটি গাজীপুরে কাশিমপুরের নয়া পাড়ায় অবস্থিত। এই কারখানায় তিন হাজার কর্মীর কাজ করে। তবে রোববার ডায়িং শাখার ৭০ জন শ্রমিক দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছিল কারখানাটি।
খবর পেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত করোনা সংক্রমণ রোগ প্রতিকার নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল আইন ২০১৮-এর ধারা অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি কারখানার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়। একই দিন সিরামিক খাতের প্যারাগন সিরামিকস লিমিটেডকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও কারখানার কার্যক্রমও বন্ধ করা হয়। সব মিলিয়ে সোমবার দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় দেড় শতাধিক কারখানা খোলা ছিল। আগের দিন রোববারও প্রায় তিন শতাধিক কারখানা খোলা ছিল।
রোববার বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত থাকলেও প্যাকেজিং ও কার্টন কারখানা খোলা ছিল ৯টি। যার মধ্যে একটি কারখানা আশুলিয়া-সাভার এলাকার। গাজীপুরের পাঁচটি, নারায়ণগঞ্জের দুটি ও ময়মনসিংহের দুটি কারখানা খোলা ছিল। সিরামিক কারখানা খোলা ছিল মোট পাঁচটি। এর মধ্যে আশুলিয়া-সাভারে একটি, গাজীপুরে তিনটি ও খুলনায় একটি কারখানা খোলা ছিল। শিল্প এলাকাগুলোতে প্লাস্টিক কারখানা খোলা ছিল দুটি। রি-রোলিং মিল খোলা ছিল দুটি। অ্যাকসেসরিজ কারখানা খোলা ছিল চারটি। এছাড়া খোলা ছিল সিমেন্ট, প্রসাধনী প্রস্তুত ও ফোম তৈরির কারখানা।
অথচ ঈদের ছুটির পর ২৩ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত সার্বিক কার্যাবলী ও চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১৯ জুলাই এক নির্দেশনায় বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত কার্যক্রমের মধ্যে ছিল খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন-প্রক্রিয়াকরণ মিল-কারখানা, কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ এবং ওষুধ, অক্সিজেন ও কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনকারী শিল্প। সরকারের এ ঘোষণার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত বেশ কয়েকটি খাতের কারখানাও খোলা রাখা হচ্ছে।
সোমবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে শিল্পকারখানা খোলার প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ২৩ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। এই বিধিনিষেধ থাকবে আগামী ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত। খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত মিল-কারখানা; কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহন, সংরক্ষণ এবং ওষুধ শিল্পকারখানা বাদে সব শিল্পকারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস বিধিনিষেধে বন্ধ থাকার কথা।
বিধিনিষেধের মধ্যেও অনেকে শিল্পকারখানা চালু রেখেছেন- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কেউ খুলে থাকলে তা পর্যবেক্ষণ করছি, কারা খুলছে? যদি খুলে থাকে, প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের ডিআইজি মাহাবুর রহমান বলেন, করোনা রোধে সরকারের বিধিনিষেধে যেন কলকারখানা খোলা না থাকে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখছি। কোথাও কোনো সংবাদ পেলে সেখানে গিয়ে সত্যতা যাচাই করছি। কার্যক্রম চলমান থাকলে বন্ধ করে দিচ্ছি।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সরকার নির্ধারিত নিয়মের বাইরে কেউ কারখানা চালু রাখলে দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। আমরা বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে কারখানা বন্ধ রাখার জন্য বলেছি।
ব্যবসায়ীদের অপর সংগঠন বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে থাকায় কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। তবে এ সময়ে যে ক্ষতি হবে তা কাটিয়ে ওঠার বিষয়েও তত্পর হয়েছে শিল্প মালিক প্রতিনিধি সংগঠন বিকেএমইএ। ২৪ জুলাই সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, আমরা চলতি বিধিনিষেধ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুনরায় প্রণোদনা সহযোগিতার আবেদন জানাব।
এদিকে সোমবার বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানায় অবস্থানরত (আবাসিক) কর্মীদের হয়রানি না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে নিটওয়্যার কারখানার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ। সংগঠনের সভাপতি ও এমপি সেলিম ওসমান স্বাক্ষরিত চিঠিটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লা ও ফেনীর জেলার প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, সরকার ঘোষিত চলমান বিধিনিষেধের প্রতি বিকেএমইএ’র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সবার আগে মানুষের জীবন এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা। তাই বিধিনিষেধ বিষয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ প্রতিপালনে আমরা প্রতিশ্রুতবদ্ধ।
এ বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন যে, বিধিনিষেধে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই শিল্পে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এত বড় বড় কারখানাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে কারখানার অভ্যন্তরে বাধ্যতামূলকভাবে স্বল্পসংখ্যক লোকবল নিয়োজিত রাখতে হয়। কারখানা বন্ধ থাকার সময় গ্যাস ও বিদ্যুতের চাপ বেশি থাকে। তার ওপর বর্তমানে প্রচণ্ড গরম পড়ছে। ফলে প্রতিনিয়ত গ্যাস ও বিদ্যুতের নিয়ন্ত্রণ সুইচ বোর্ড চেক করতে হয়, অন্যথায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। ফলে এই বিষয়গুলো মনিটরিং করার জন্যও বর্তমান সময়ে কারখানাগুলোতে স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়োজিত রাখতে হচ্ছে। তাদের হয়রানি না করার অনুরোধ করছি।
জাগরণ/এসকেএইচ