• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২১, ০৬:০২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৩০, ২০২১, ০৭:০০ পিএম

ঢাকায় গরম বাড়ছে, চিন্তিত গবেষকরা

ঢাকায় গরম বাড়ছে, চিন্তিত গবেষকরা

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় একটি মেসে ভাড়া থাকেন হাবিবুল রহমান হাবিব। পড়াশোনা শেষে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকারি চাকরির। কিন্তু গত কয়দিনের অসহ্য গরমের কারণে লেখাপড়ায় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছেন না। অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে কাটাছে তার সারাদিন। গরমে একটু শান্তি পেতে দিনের মধ্যে গোসল করছেন তিন-চারবার করে। ২৪ ঘণ্টা চালিয়ে রাখছেন ফ্যান। তাতেও গরম যেন কমছেই না।

হাবিবুল রহমান বলেন, “গত কয়েক বছরের মধ্যে এতটা গরম অনুভূত হয়নি। পৃথিবীটা দিনদিন যেন সূর্যের কাছে চলে যাচ্ছে। সারাদিন পানি পান করেও পিপাসা মিটছে না। কবে যে একটু শান্তির বৃষ্টি হবে কে জানে।”

রাতিন রহমান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, “তাপমাত্রা পরীক্ষা করে দেখি ৩৩ ডিগ্রি, কিন্তু অনুভব হচ্ছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। অর্থাৎ, গ্রীষ্মের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ৮ ডিগ্রি বেশি গরম আপনাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে এই মুহুর্তে। কেন এমন হচ্ছে? প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে একটা চুল্লির ভেতর আবিষ্কার করি। ঘরের ভেতর গণগণে তাপ, ফ্যানের বাতাস যেন লু হাওয়া। এই সেদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা দিনে রাতে সবসময়ই চলছে।  ঠোট ফেটে গেছে, গতকাল রক্ত বের হচ্ছিল। কিন্তু ঘাম নাই তেমন। স্রেফ মনে হচ্ছে ভেতরে সব জ্বলছে।”

শুধু হাবিবুল বা রাতিন নয়, এমন অসহনীয় গরমে দিশেহারা রাজধানীবাসী। প্রচণ্ড গরমের কারণে কখনো কখনো রাস্তায় মানুষ মাথা ঘুরে পড়ছে। ঢাকার হঠাৎ এমন উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত পরিবেশবিদরাও। তাদের মতে, তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। আর এটি হচ্ছে গ্রীণ হাউজ প্রতিক্রিয়ার কারণে।

মিথেন গ্যাসের কথা জানায় বিদেশী গণমাধ্যম

সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রীণ হাউজ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম উপাদান মিথেন গ্যাস। বাংলাদেশের আকাশে এই গ্যাসের রহস্যময় ধোঁয়া দেখা গেছে বলে জানা যায় ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে। এপ্রিলের শুরুতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অন্তত ১২টি স্থান থেকে নির্গত হচ্ছে মিথেন গ্যাস, এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলের জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতিকর। প্যারিসভিত্তিক গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরণ পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান জিএইচজিস্যাট ইনকরপোরেশন তাদের গবেষণা থেকে বাংলাদেশের বিষয়ে এসব তথ্য তুলে ধরলেও, তখন কোনো উৎস শনাক্ত করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

গত ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে জিএইচজিস্যাট ইনকরপোরেশনের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ জানায়, তারা বাংলাদেশে মিথেন গ্যাস নির্গত হওয়ার একটি উৎস শনাক্ত করতে পেরেছে। সেটি হলো রাজধানী ঢাকার মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড়।

জিএইচজিস্যাট ইনকরপোরেশন তথ্যমতে, ওই ভাগাড় থেকে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হয়, যা প্রতি ঘণ্টায় ১ লাখ ৯০ হাজার গাড়ি যে পরিমাণ দূষণ বায়মণ্ডলে ছড়ায় তার সমতুল্য। গত ১৭ এপ্রিল নিজেদের কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে এই মিথেন নিঃসরণ দেখতে পায় প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় ব্লুমবার্গকে জানিয়েছে, মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড় এলাকা থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা খতিয়ে দেখতে তারা একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটি এক মাসের মাধ্যে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়কে পরমর্শ দিবে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আবহাওয়াবিদের পূর্বাভাস

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জাগরণ অনলাইনকে বলেন, “রাজধানীতে যে তাপদাহ চলছে তা আরো এক-দুইদিন থাকবে। এরপর অবস্থা কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু তারপরও গরমের যে অস্বস্তিকর অনুভূতি তা থাকবে। এপ্রিল-মে মাসে বায়ুতে জলীয় বাষ্প মাত্রা বেশি থাকায় মানুষ ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও অস্বস্তি বোধ করে।”

এই আবহাওয়াবিদ আরো বলেন, “প্রতি বছর স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই অঞ্চলে এপ্রিল-মে মাসে তাপপ্রবাহ হয়। এই বছর এই তাপপ্রবাহ এপ্রিল মাসে বেশ জোরালো হয়েছে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এটা টানা চলছে বলা যায়। হয়তো কোনোদিন তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি কমেছে, কিন্তু পরের দিন আবার লাফিয়ে আগের জায়গায় চলে গেছে।”

বর্ষাকাল না আসা পর্যন্ত এমন তাপদাহ থাকতে পারে বলে জানান তিনি। আব্দুল মান্নান যোগ করেন, “এখন যেমন কোনো কোনো অঞ্চলে টানা ২০-২২ দিন বা ঢাকায় টানা সাতদিন তাপপ্রবাহ ছিল, মে মাসে এমন টানা না থাকলেও কয়েকদিনের জন্য তাপপ্রবাহ হওয়ার সম্ভবনা আছে। এমনকি জুন মাস পর্যন্ত এটা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষাকাল না আসা পর্যন্ত এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থাকতে পারে।”

পরিবেশবিদদের বক্তব্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম নাজেম বলেন, “ঢাকায় যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, সেটার ব্যবস্থাপনা আমরা ঠিক মতো করতে পারি না। ফলে এখান থেকে যে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয় এটা ঠিক। তবে শুধু মাত্র যে বর্জ্য থেকেই মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয় তা নয়। আরো অনেক উৎস আছে, যেমন- কৃষি থেকে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।”

তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, “ঢাকার অবকাঠামোগুলো তাপমাত্রা ধরে রাখে। যার কারণে মানুষ যে তাপমাত্র অনুভব করার কথা তার থেকে বেশি অনুভব করে। শহরে এবং গ্রামে একই তাপমাত্রা হলেও গ্রাম থেকে শহরে বেশি অনুভূত হয়।”

এই অধ্যাপক আরো বলেন, “বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের অবদান একেবারেই নগণ্য। কিন্তু এর ফলে যে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে সেটা আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বড় বড় শহরগুলোতেও বায়ু দূষণ হয়, কিন্তু তারা সেটাকে একটা সহনীয় মাত্রায় ব্যবস্থাপনা করে। কিন্তু আমরা দূষণে সহনীয় মাত্রায় রাখতে পারছি না। এটা হলো আমাদের ব্যর্থতা।”

এই বিষয়ে নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “ঢাকার উত্তপ্ত অবস্থা যে দেড় থেকে দুই ডিগ্রি বেড়েছে এটা আমরা গত ১২ বছরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়েছি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমার পুরো নগরীর সবুজ গাছ এবং আচ্ছাদন কেটে সেখানে কংক্রিটের পাকা দালান উঠাচ্ছি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের বর্জ্য অব্যবস্থাপনা। উন্মুক্তভাবে রাখা এসব বর্জ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের গ্যাসীয় উপাদান বের হয়ে পরিবেশটা উত্তপ্ত হচ্ছে। আর একই সঙ্গে সামর্থ্যবান মানুষ অতিরিক্ত ঠান্ডা অনুভূতির জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মাধ্যমে ঘরের সহনীয় তাপমাত্রাকে বাইরে বের করে দেয়। এতে যার সামর্থ্য নেই তার ঘাড়ের ওপর পড়ছে অতিরিক্ত গরম।”

ইকবাল হাবিব বলেন, “বর্জ্য আমাদের সম্পদ। পৃথিবীর অনেক দেশে বর্জ্য থেকে তরল সার তৈরি হয়, বিদ্যুৎ তৈরি হয়। আমরাও গত চার-পাঁচ বছর ধরে এগুলো নিয়ে অনেক গালগল্প করছি। কিন্তু একটা প্রকল্পও হয়নি। ফলে এই বর্জ্য শুধু মিথেন গ্যাস ছড়াচ্ছে তা নয়, এই বর্জ্য আমাদের মাটি দূষণ করছে, পানি দূষণ করছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আমরা উত্তাপ এবং দূষণের শিকার হচ্ছি।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক বিধান চন্দ্র পাল বলেন, “তাপমাত্রা যে বেড়েছে সেটা আমরা সার্বিকভাবে অনুভব করছি সবাই। আগে আমরা এটা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু এখন আমরা বুঝতে শুরু করছি। যে সময় তাপমাত্রা বাড়ার কথা না, সে সময় বাড়ছে, যে সময় কমার কথা বা শীতকাল থাকার কথা, সে সময় শীতকাল থাকছে না। ফলে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি আমরা লক্ষ্য করছি। আবহাওয়ার এই অস্বস্তিকর আচরণ, জলবায়ুর যে পরিবর্তন, এটা আমরা এখন একটু একটু করে বুঝতে পারছি। সাধারণ মানুষরাও এটা অনুভব করছে, যে আসলেই কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ ঝুঁকিতে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ।”

এই পরিবেশবিদ আরো বলেন, “এতদিন ধারণ করা হতো যে, দেশের আকাশে কার্বন ডাই অক্সাইডের আনাগোনার কারণে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে এখন নতুন করে যুক্ত হলো মিথেন গ্যাস। তাই সম্প্রতি ব্লুমবার্গে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা যেমন আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে কোনোভাবে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এই বিষয়টি আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে এবং করণীয় ঠিক করতে হবে।”

বিধান চন্দ্র পাল আরো বলেন, “বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে মিথেন গ্যাসের ক্ষেত্র আবিষ্কার হওয়াটা অস্বাভাবিক তবে অবাস্তব নয়। কারণ ধানক্ষেতের জলাবদ্ধ মাটিতে ব্যাকটেরিয়া হয়, সেখানে বিপুল পরিমানে মিথেন গ্যাস তৈরি হয় বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে মিথেন গ্যাস সৃষ্টির আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে বলে আমার ধারণা।”

জলাশয়ের কচুরিপানা মিথেন গ্যাস উৎপাদনের অন্যতম বড় ক্ষেত্র হতে পারে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “জলাশয়,গরু-ছাগলের মল, সাধারণভাবে পঁচে যাওয়া বর্জ্য, প্রাণীর দেহাবশেষ, পঁচে যাওয়া শাক-সবজি থেকেও মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। আবার অব্যবহৃত জমি, শহরের বড় বড় ড্রেন থেকেও মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হতে পারে। এগুলো গবেষণা করে দেখা দরকার। তাহলে আমরা আরো সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারবো এতে মানুষের অবদান কতটুকু? ব্যবস্থাপনাগত ঘাটতি কতটুকু? বা অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান কতটুকু? আর সেই অনুসারে আমরা করণীয় নির্ধারণ করতে পারবো।”

উষ্ণতা প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। তা না হলে সামনে মানবজাতির জন্য ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। তাই এই বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে আরো গভীরভাবে গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করে পরিবেশবিদরা।