অনেকে মনে করেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ পুরানো ইতিহাস, আলোচনা হয়েছে অনেক। আবার কেন নতুন করে এতো আয়োজন! কিন্তু আমরা জানি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এত বেশি আলোচিত হয়নি, যে পরিমাণ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশবিরোধী মগজ ধোলাই হয়েছে নতুন প্রজন্মের মাঝে। ৩৪ বছর অবিরত চলেছে এ ধোলাইয়ের কাজ, সে তুলনায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু আলোচনায় এসেছে অতি সামান্য। ১৫ আগস্টের মত বিভিন্ন উপলক্ষ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর কথা খুব বেশি ছাপানো হয় না বা আলোচিত হয় না। কেন? বঙ্গবন্ধু নিজেই একটি উপলক্ষ এবং সর্বাত্মকভাবে আলোচিত হবার মত, এ সত্য আমরা কবে অনুধাবন করবো? বঙ্গবন্ধু নিয়ে আমাদের এ মানসিক দৈন্যদশা না ঘুচলে বাংলাদেশের দৈন্যতা ঘুচবে না।
‘‘বঙ্গবন্ধু নিয়ে আমাদের এ মানসিক দৈন্যদশা না ঘুচলে বাংলাদেশের দৈন্যতা ঘুচবে না।’’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের ভাবতে হবে, তাঁকে জানতে হবে সঠিক ভাবে। তাঁর ধর্মীয় চেতনা ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, ভক্ত সদস্যই অন্ধকারে হাবু-ডুবু খায়। আমরা ক’জন জানি বিশ্ব ইস্তেমার ব্যবস্থা করেছেন বঙ্গবন্ধু, তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ?
পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম লীগ সভাপতি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেট মুসলিম বলেছেন। তবে, সাত কোটি বাঙালির ভালবাসার কাঙাল বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগ নিয়ে ধর্মতত্ত্ব আবার ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে অপকর্মের সূচনা যে হয়নি, এমন নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপের কারণে কোন অপকর্মই এদেশে হতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার সাক্ষ্য’ গ্রন্থের ২৬ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি সেখানে বলেছেন- “স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমরা অনেক অপকর্মের উদ্ভাবনা করেছি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষারক্ষেত্রে সরকারী অনুদান সম্পূর্ণ বন্ধকরে দেয়ার প্রস্তাব। তৎকালীন শিক্ষা সচিব এই অনুদান বন্ধের প্রস্তাব প্রধান মন্ত্রীর কাছে করেছিলেন। প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি। উপরন্তু তিনি মাদ্রাসার অনুদান বৃদ্ধি করেছিলেন। এরপরে আলিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য তিনি সর্বোতভাবে সাহায্য করবেন। তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘আসুন আমরা মিলিতভাবে দেশ থেকে ঘুষ, জুয়া ইত্যাদি অনৈসলামীক কাজের উচ্ছেদ ঘটাই। আমি রেস খেলা বেআইনী ঘোষণা করেছি। আপনারা আমার হাতকে সুদৃঢ় করুন। সর্বপ্রকার পাপের মূলোচ্ছেদ না করলে এদেশকে রক্ষা করা যাবে না।’
স্বাধীনতার আগে ও পর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এবং অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার ও তাদের দালালেরা দেশের ভেতর এবং বাহিরে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নামে ধর্মীয় কুৎসা রটনা করছে এবং এখনও করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে ব্যারাকি রাজাদের আমন্ত্রণে রাজাকার, আলবদর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ধর্মান্ধ ব্যবসায়ীরা দেশে ফিরে আসে এবং মহোৎসাহে বঙ্গবন্ধুর নামে ধর্মীয় অপপ্রচার শুরু করে। ধর্মান্ধ ব্যবসায়ীরা টাকার পাহাড় গড়ে, যা এখনো বিদ্যমান।
স্বাধীনতার পর দেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পুনরুত্থানে সরলপ্রাণ মুসলমানদের মনে বিষ ছড়াতে এবং তাদের অসৎ উদ্দেশ্যে সাধন করতে বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতৃত্বের প্রশ্ন তুলে এ চক্র। তারা এ কথা বলে যে, জাতির পিতা দুই জন হবে কি করে। তাহলে তারা কি এখনো জিন্নাকেই বাঙালি জাতির পিতা মনে করে। সে তো পাকিস্তানের জাতির পিতা, মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ। ইব্রাহিম (আ:) তো মুসলিম জাতির পিতা; আবরাহাম খ্রিস্টান জাতির পিতা। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জাতির পিতা আছে। যেসব জাতির পিতা নাই, তাঁরা এখনো পরাধীন, তাঁদের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নাই। জাতীয় সত্তা তাঁদের এখনো শৃঙ্খলে, তাঁদের স্বপ্ন একজন জাতীয় পিতা বা জাতীয় নেতার। যাঁর ডাকে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হয়ে বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত জিন্নাহকে পাকিস্তানের জাতির পিতার সম্মান দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে তিনি অন্যান্য দেশ ও জাতির প্রতি সম্মান ও তাঁদের জাতির পিতার ও জাতীয় নেতাদের সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আসে নির্বাচন ধর্মান্ধ ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করা হয় তাতে, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রচারনায়। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে এরা নাস্তিক, ভারতের দালাল বলে গালি দিতেই বেশি পছন্দ করে।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জনক এ কথা স্বীকার করতেও অস্বীকার করে। তারা বলে আমাদের জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ:)। ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগোরিষ্ঠ অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ‘মুসলিম লীগ’ এর প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্’র হাতে বৃটিশ সরকার ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেয়। এ কারণেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতির পিতা। ১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত পাকিস্তানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, হয়েছে মতাদর্শের উত্থানপতন, কিন্তু জিন্নাহ্’র পিতৃত্ব নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক হয়েছে বলে শুনিনি। যত সমস্যা আমার সোনার বাংলায়। শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে। এ উপাধি শেখ মুজিবের স্বঘোষিত নয়। তৎকালীন সম্মিলিত ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এ ঘোষণা আসে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিব। ১৯৭১ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে বলে তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা। বাঙালি জাতির পিতা। চলবে...
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বীক।
সম্পাদনা : এস এম সাব্বির খান