বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি জীবনে ধর্ম নিবিড়ভাবে জড়িয়েছিল। ইসলামী দর্শন, ইসলামি জীবন বিধান তিনি তাঁর ব্যক্তি জীবনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় যতটা ব্যবহার করেছেন, তা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছেন। যার প্রেক্ষিতে তিনি প্রমাণ করেছেন- একজন আদর্শ মুসলমানের অধীনে সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি সমন্বিতভাবে একটি ঐকিক জাতিসত্তায় পরিণত হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাথে কখনো ধর্মীয় জুয়া তিনি খেলেননি। এ ধর্মীয় জুয়া, ফাঁকিবাজি, ধোঁকাবাজি, ধান্ধাবাজি ১৯৪৭ সালের পার থেকে বঙ্গবন্ধু ব্যতীত প্রত্যেক সরকারই কম-বেশি করেছে। পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ্’র ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবন হাস্যকর, করুণও বটে। প্রচুর অর্থবিত্ত এবং আইন ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি ঘনঘন বৃটেন যেতেন, কিন্তু হজে যাননি কখনো। বিয়ে করেছেন অগ্নিপূজারী স্যার দীনশা বোম্বাই-এর কন্যা ‘রটী বাঈ’কে। তাদের একমাত্র বংশধর কন্যা ‘দীনা বাঈ’ বিয়ে করেছে জুরস্ত্রি অগ্নিপূজারীকে। অর্থাৎ জিন্নাহ্’র বর্তমান বংশধরেরা অগ্নিপূজারী। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল শুধু মাত্র ‘মুসলমান’ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। এ ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর কোন মিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা এ দেশের উপর তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে যে অপকর্ম করে তা সহজে বোধগম্য হয় ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম, দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, ডিসেম্বর ২০০৭, পৃ. ৩’ পাঠে। সেখানে বলা হয়েছে- “দ্বীনদার মুসলমানদের সমর্থন কুড়ানোর জন্য ফাঁকিবাজি ও ধোঁকাবাজির জাল চড়িয়ে কেবল শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান আমল সংরক্ষণ করার পরিবর্তে ইসলামের উপর ক্ষুর চালাতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি তারা।.....আল্লাহর আইনে দেখেছিল তারা সম্মানের হানি, ইজ্জতের অবমাননা।” আশ্চর্যে ব্যপার যে, “যে জিন্নাহ্ ও লিয়াকত আলী খানেরা যারা একদা বাংলাকে কুফরি বা পৌত্তলিক ভাষা বলে ঘৃণার চোখে দেখেছিল তাদের কবরে আল্লাহ্ সুবাহানাহু তাআলা বাংলা ভাষাকে চিরতরে খোদাই করে দিয়েছেন। জিন্নাহ সাহেবের কবরে মার্বেল পাথরের উপরে উর্দূর পাশাপাশি বাংলায় তার জন্ম ও মৃত্যু তারিখ খোদাই করা আছে, লিয়াকত আলী সাহেবের কবরের মার্বেল পাথরের উপরে বড় করে বাংলায় খোদাই করা আছে- ‘কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান’ (প্রবন্ধ : মোহাম্মদ জমির হায়দার বাবলা, ইসলাম ও আমাদের ভাষা আন্দোলন)।”
১৯৪৭-এর পর সব সরকারই ধর্ম নিয়ে ‘ধান্ধা’ করেছেন ব্যতিক্রম শুধু জাতির পিতা শেখ মুজিব
মজার ব্যপার হলো জিন্নাহ উর্দূ এবং বাংলা কোনো ভাষাই জানতেন না। তিনি ছিলেন গুজরাটের ইসমাঈলী শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। জেনারেল জিয়াউর রহমান তো ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে মদ, জুয়া, হাউজি, পতিতা ব্যবসার মত অনৈসলামিক কার্যক্রমের লাইসেন্স দিয়ে দেশে সে ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করে যান। যা, বঙ্গবন্ধু বেআইনি করেছিলেন। বেগম জিয়া তার স্বামীকেই অনুসরণ করেছেন মাত্র, পঞ্চম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে। এরশাদের সরকারও অনৈসলামিক কাজের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
প্রত্যেক মানুষের জীবন ধারায় দু’টি প্রবাহিত ধারা থাকে। একটি ব্যক্তিগত, অপরটি সামগ্রিক। বঙ্গবন্ধুর এ দু’টি জীবন ধারার কোথাও ধর্মহীনতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মের শাসন মেনে চলেছেন। তাঁর পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তার প্রতিফলন দেখা যায়। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাই মূলত বঙ্গবন্ধুকে মানুষের কাছে এনেছিলো, যে মানুষেরা তাঁকে প্রতিদান দিয়েছেন জাতির পিতার মর্যাদার। পৃথিবীর কোনো ধর্মেই অন্যায় অত্যাচার সমর্থন করেনি, মানুষকে ঘৃণা করার উপদেশ দেয়নি। পবিত্র ধর্মগুলোর উপদেশ সৃষ্টির মাঝে মানুষের শান্তি স্থাপন। ভালোবাসার মাধ্যমে একে অপরের নিকটে আসার প্রেরণা। কিন্তু যখন মানুষ সেই পবিত্র ধর্মের নামে, ইসলামের নামে শোষণ-অত্যাচার, ঘৃণার সূচনা করলো, তখন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এর প্রতিবাদ করলো। বাংলাদেশের তেমন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদ বাঙালির মুক্তির পথকে প্রসারিত করলো। জাতীয়তা বোধের আলোয় আলোকিত হল বাঙালির মন-প্রাণ। এলো মুক্তি, স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যে বা যারা বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিয়ে নিন্ধা করে বা করে আসছে, তারা বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনে একটি মাত্র অনৈসলামিক কাজের সন্ধান দিতে পারবে বলে মনে হয় না, রাষ্ট্র পরিচালনায় তো সম্ভবই না।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই লাহোরে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান, টুঙ্গীতে বিশ্ব ইস্তেমার ব্যবস্থা, ইসলামী ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশে সকল প্রকার অনৈসলামীক কার্যক্রম বেআইনী ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেট মুসলিম না হতেন তাহলে ধর্মীয় এত সব সংস্কার মূলক কাজ করতে যাবে কার স্বার্থে আর সংস্কারের মত কাজে যে পরিমান সৎসাহস প্রয়োজন হয় তাইবা পাবেন কোথা থেকে? ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান সরকার যা ২৪ বছর শাসনামলে করতে পারেনি বা করেনি বরঞ্চ অনৈসলামি কাজের প্রসার তারা করে গেছে। পরবর্তী কালে ব্যারাকী শাসকেরা পাকিস্তানী শাসন পূর্ণ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ফায়দা লুটেছে এবং জাতীয় নৈতিক চরিত্রের অধ:পতন করেছে। মদ, জুয়া, হাউজী, আফিম অর্থাৎ সকল প্রকার নেশা এবং পতিতালয়ের মত অপরাধ মূলক কাজ পবিত্র ইসলাম সহ পৃথিবীর কোন ধর্মই স্বীকৃতি দেয়নি। সে সব নিষিদ্ধ হারাম কাজ-কর্ম এদেশে সরকারী মদ্দে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ্’ সংযোজনের পর নতুন করে শুরু হয়েছে। ‘বিসমিল্লাহ্’ বললে অপরাধ মূলক কাজ যা ধর্মীয় আইনে যা নিষিদ্ধ, তা কি করে হালাল হয়ে যায়? যদি হালাল না হবে, তাহলে জেনারেল জিয়া কিংবা বেগম জিয়ার প্রসঙ্গে ধর্মীয় বিধি লঙ্গনের অভিযোগ আসে না কেন? জাতীয় বিবেকের কী ধর্মীয় অনুভূতি একেবারেই, ভোঁতা হয়েছে? বাঙালি জাতি চির কালই ধর্ম ভীরু, তাঁদের এ ভীরুতার সুযোগ নিয়ে যে বা যারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে, জাতির আজ দিন এসেছে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় শাসন ব্যবস্থাকে অনুস্মরণ করে দেশের সকল প্রকার অনৈসলামিক এবং অনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন আর ব্যারাকী শাসক গোষ্টি বাংলাদেশে পাকিস্তানামলের অরাজকতা সৃষ্টি করে, যুব সমাজের অধঃপতন করে শাসন কার্যক্রম দীর্ঘ করার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু ইসলামের নাম বিক্রি করে পাকিস্তান যেমন বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি, তেমনি নব্যদেশির পাকিদের নীলনকশারও ব্যবস্থা বাঙালি করেছে বলে বিশ্বাস করি। মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের ধর্মচিন্তার ফলে যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, পাকিস্তান ধ্বংসও হয়েছিল সে সব ধার্মিক বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টায় আর সে চেষ্টাতরীর মাঝি ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
ইসলামি চিন্তার আদর্শ পুরুষ সৈয়দ আলী আহসানের বক্তব্য হলো- “আজ অনেকটা পিছনে দৃষ্টি ফেলে অনুভব করতে পারি যে, আমাদের সকলের কাছে তখন পাকিস্তান ছিল একটি বিরাট আদর্শ ভৌগোলিক বন্ধনিতে অবদ্ধ কোন রাষ্ট্র নয়, কিন্তু ইসলামী আদর্শের তাৎপর্যবহ একটি অনুভূতি, এই বিশেষ অনুভূতিটাই আমাদের অনেককে অন্ধ করে ফেলেছিল। আমরা পাকিস্তানকে সকল কিছুর উর্ধ্বে স্থান দিতে শিখেছিলাম। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রয়োজন হয়নি। বরং অল্পদিনেই পাকিস্তানের প্রতি আমার মোহভঙ্গ হয়েছিল এবং ক্রমশ: পাকিস্তানকে অস্বীকার করার সামর্থ্য আমি অর্জন করেছিলাম।” তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (ক্ষমতাসীন) মুসলীম লীগ পাকিস্তান অস্বীকার করার সামর্থ্য অর্জন করতে না পারলেও তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক) সভাপতি কাজী কাদেরের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে জানা যায় আফরোজা নাজনীনের নেয়া এ সাক্ষাৎকারে কাজী কাদের বলেন, ‘শেখ মুজিবের বিজয়ের পর আমিই শাহবাগের পেছনের গ্রীন হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিলাম ‘‘ণড়ঁ যধহফ ড়াবৎ ঢ়ড়বিৎ ঃড় গঁলরন’ ইয়াহিয়া তা করেনি। পরিণামে বিপর্যয় এসেছে।” মুসলিম লীগ সভাপতির এমন ঘোষণার ফল কি না জানি না, তবে পাকিস্তানের দালালিতে তাদের তুলনায় জামাতের সদস্য সংখ্যা বেশি ছিল বলে মনে হয় এবং এখনো জামাত পন্থিদের মধ্যে পাকিস্তান প্রেম দেখা যায় বেশি। জামাতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদেই মুক্তিযোদ্ধারা লাঞ্ছিত হয়, বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে ধর্মীয় অপপ্রচার হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে মুসলীম লীগের পরাজয়, আওয়ামী লীগের বিজয় এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম লীগের আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তররের দাবী এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান তাদের (মুসলীম লীগ সদস্য) বাঙালি জাতীয়তা বোধেরই স্বীকৃত বলে বিবেচিত। ১৯৮৭ সালের ১৭ জানুয়ারি নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ৭২তম মৃত্যু বার্ষিকী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বলেন ‘‘আজকের বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথাটি অকৃপণভাবে সকলকে স্বীকার করতেই হবে।” কাজী কাদেরের দাবী, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যদি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের জাতির পিতার মর্যাদা দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতির পিতার মর্যাদা দিতে দোষের কিছু নাই।’ ৪৭-এ দেশ বিভাগের সোনালী স্বপ্ন ছিল, ইসলামী আদর্শে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার কোনোটাই পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিফলিত হয়নি, সব কিছুতেই ছিল বৈষম্য। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ সে বৈষম্য দূর করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী শাসনামলে ঐ বৈষম্য এবং ধর্মীয় অত্যাচার এত বেশি ভয়াবহ হয়ে পড়েছিল যে, বাঙালির স্বাধীনতা ছাড়া অন্যপথ ছিল না।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বীক।
সম্পাদনা : এস এম সাব্বির খান