• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০, ০৫:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০, ০৫:৩১ পিএম

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট ‘টাংগুয়ার হাওর’

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট ‘টাংগুয়ার হাওর’
ফাইল ছবি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি খ্যাত পাহাড় ঘেরা সবুজের হাতছানিতে সৌন্দর্য্যের ডালপালা ছড়িয়ে এক নৈর্স্বগিক সৌন্দর্য্য সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওর। নানান প্রজাতির জলজ, স্বচ্ছ পানি, হিজল করচ ও বহু প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম যাকে বলা হয় মাদার ফিশারিজ। জল জ্যোস্নার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিনিয়ত প্রকৃতি প্রেমিদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।

বিশেষ করে শুক্র শনিবারে দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে টাংগুয়ার হাওর, নীলাদ্রি লেক, বারিকটিলা, রূপের নদী যাদুকাটা ও প্রখ্যাত শিমুলবাগানসহ আশপাশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। সরকারীভাবে টাংগুয়ার হাওর কেন্দ্র ইতিমধ্যে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে উপলক্ষ্যে হিসেবেই চলছে অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজ। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া-জন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে বিপুল সম্ভাবনা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি মাদার ফিসারিজ খ্যাত রামসার সাইট টাংগুয়ার হাওর। এ হাওর বাংলাদেশে উত্তর-পূর্ব দিগন্তে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলা তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলা মধ্যনগর থানায় অবস্থিত।

এ ছাড়াও দেশের এই প্রান্তিক জনপদে মহান রাব্বুল আলামিন যেন প্রকৃতি-অকৃপণ হাতে বিলিয়ে দিয়েছেন অফুরন্ত সম্পদ, সম্ভাবনা আর অপরূপ নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য। পাখি, সারি সারি হিজল, করছগাছসহ বিভিন্ন জাতের গাছপালা আর হাওরের বুকে জলজ উদ্ভিদ, লতা, গুল্ম, স্বচ্ছ জলরাশি, নৌকায় চড়ার সময় পানি নিচের দিকে তাকালে বনজ গাছ, গুল্ম, মাছের তীব্রগতিতে চলা অনায়াসে চোখে পড়ে। হিজল, করছ, বলা, ছালিয়া, নলখাগড়াসহ নানান প্রজাতির বনজ ও জলজ প্রাণি টাংগুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ হাওরে শুধু বাংলাদেশের প্রকৃতিপ্রেমীরাই শুধু ছুটে আসে না। দেশের সীমানা পেরিয়ে অপরূপ এই নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য দেখতে বিদেশ থেকেও ছুটে আসেন প্রতিনিয়ত হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমন পিপাসুরা। ফলে, টাংগুয়ার হাওর বাংলাদেশের মানচিত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। টাংগুয়ার হাওরের নাম বললেই হাওর কন্যা সুনামগঞ্জের নাম চলে আসে। এ সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটক ও দর্শনার্থীরা টাংগুয়ার হাওরে এসে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে প্রশান্তি উপভোগ করেন। শীত মৌসুমে হাওরের সৌন্দর্য্য ফুটে উঠে চোখে পড়ার মত এক অকল্পনীয় দৃশ্য।

সুত্র জানায়, পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১ হাজার ৮৫৫ প্রজাতির পাখিই এ হাওরে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। এসব বিদেশী পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠে হাওর পাড়ের ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৮৮টি গ্রাম। সুদুর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ শীতপ্রধান দেশ থেকে শীতের তীব্রতার হাত থেকে বাচঁতে বিভিন্ন জাতের অতিথি পাখি ডানায় ভর করে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করে বিশাল টাংগুয়ার হাওরের বুকে। প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ হাজার অতিথি পাখি আসে এ হাওরে। এসব অতিথি পাখির কলধ্বনিতে বিশাল টাংগুয়ার হাওরপাড় এলাকায় কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে সকালে মানুষের। সারাদিন কলকাকলি, কিছিরমিছির শব্দ, নীল আকাশে উড়ে বেড়ানো ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার অতিথি পাখিগুলো অপরূপ দৃশ্য, পাখিগুলো একে একে পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্যটা কাছ থেকে দেখে যে কারোরেই চোখ জুড়িয়ে যায়। শীতের রাতে পূর্ণিমা আর ঘোর আঁধারে আকাশে অতিথি পাখির ডাকে এক ভিন্ন রকম আমেজ সৃষ্টি করে। 
 
টাংগুয়ার হাওরের আয়তন : সীমান্ত ঘেঁষা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫২টি হাওরের সমন্বয়ে ৯৭২ হেক্টর জমি নিয়ে টাংগুয়ার হাওরের অবস্থান। আর এ কারণেই এটি জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি। শুষ্ক মওসুমে টাংগুয়ার হাওরের অন্তর্গত ৫১টি জলমহালের আয়তন ছয় হাজার ৯১২ একর হলেও বর্ষায় তার বিস্তৃতি দাঁড়ায় প্রায় ২৪ হাজার একর সীমানা বিহীন বিশাল সমুদ্রের ন্যায়। টাংগুয়ার হাওরকে ঘিরে একটি প্রবাধ আছে- ‘ছয়কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দার সমম্বয়ে হাওরপাড়ের মানুষের জীবন বান্ধা’ অর্থাৎ এই হাওরকে ঘিরে ৮৮টি গ্রামের ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহের পথ।  

রামসার সাইট ঘোষণা : ১৯৯১ সালে ইরানের রামসার নগরে অনুষ্ঠিত বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সম্মেলনে গৃহীত রামসার কনভেনশন অনুযায়ী টাংগুয়ার হাওরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইটে আনার পর সরকারের সুনজর পড়ে জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ মিঠাপানির এই হাওরের বিপুল সম্পদে সমৃদ্ধ টাংগুয়ার হাওরের উপর। সুন্দরবনের পর টাংগুয়ার হাওরকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসেবে ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয়। পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মোট ১ হাজার ৩১টি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়েছে। তম্মধ্যে টাংগুয়ার হাওরই সর্বশেষ রামসার সাইট। ২০০৫ সালে এই হাওরকে জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। 

টাংগুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র : টাংগুয়ার হাওরে বর্তমানে প্রায় ২০৮ প্রজাতির দেশী-বিদেশী পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী বসবাস করছে। এর মধ্যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির সম্মুক্ষীণ ১০ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির সাপ, ৩ প্রজাতির কচ্ছপ, ২ প্রজাতির গিরগিটি ও ১ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্নের দিকে প্রায় ৫৫ প্রজাতির মাছ ও ৩১ প্রজাতির পাখি তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিশাল সাম্রাজ্যের টাংগুয়ার হাওরকে বেছে নিয়েছে। এসব পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক, মৌলভীহাঁস, পিয়ারী, কাইম, কালাকুড়া, রামকুড়া, মাথারাঙ্গা, বালিহাঁস, লেঞ্জা, চোখাহাঁস, চোখাচোখি, বিলাসি শালিক, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়াংহাস, সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা, ভুতিহাঁস, লরালশির, নীলশির, পাতিহাঁস প্রমুখ। এ ছাড়াও বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়াল (বাংলাদেশের নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। 

২০১১ সালে পাখি শুমারিতে এই হাওরে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখির ২৮ হাজার ৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। কিন্তু, এসব পাখি এখন আর আগের মতো নেই। দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহল। তাদের মতামত অনুযায়ি এখন টাংগুয়ার হাওর আর আগের মতো নেই। হাওরের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে এবং মৎস্য শিকার বন্ধ করতে হবে। অতিথি পাখির আগমন ধারা অব্যাহত রাখতে চাইলে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এ হাওরে মাছ, পাখি শিকার বন্ধ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন কার্যকর না হলে বিপন্ন হবে টাংগুয়ার হাওরের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র। 

টাংগুয়ার হাওরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা জানান, বিরল ও বিলুপ্ত প্রায় নানা জাতের মৎস্য সম্পদ আর পাখির এক নিরাপদ আবাসস্থল হাওর হলেও হাওরটি এখন আর আগের মতো নেই। টাংগুয়ার হাওর,যাদুকাটা নদী, বারেকটিলাসহ একাধিক দর্শনীয় স্থান থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় ভ্রমন পিপাসু পর্যটকরা মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়। সরকারীভাবে উন্নত মানের আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলেও এই হাওরকে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে খুব সময় লাগবে না। যা দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শহর থেকে আসা পর্যটকরা মুগ্ধ হবেন এবং আমরাও মুগ্ধ হয়েছি।
 
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনা সিন্দু চৌধুরী বাবুল জানান, হাওর বেষ্টিত তাহিরপুর উপজেলায় টাংগুয়ার হাওর একটি মূল্যবান সম্পদ। এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত কাঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়ায় পর্যটন শিল্প বিকশিত হচ্ছে না। তবে বর্তমান সরকার টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘিরে ইতিমধ্যে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ জানান, টাংগুয়ার হাওর রক্ষায় আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তারপরও হাওরের ক্ষতি হয় এমন কাজ কেউ করলে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এর সাথে পর্যটকদের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে টাংগুয়ার হাওরের জীব বৈচিত্র রক্ষায় সরকারকে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীর ভুমিকা প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের। 

জাগরণ/এমএইচ

আরও পড়ুন