আজকাল অনেকেই প্রশ্নটা করে, আমি অল্প বয়স্ক বাচ্চাদের কথাই বলছি। ‘আপনাদের সময় ঈদ কেমন হতো?’ প্রশ্নটা শুনে আমার মনে হয় আমি যেন সেই গুহা যুগের নিয়ানডারথেল মানুষ। সেই আমাদের আবার ঈদ। বয়সের যদি হিসাব করি, তাহলে বলতেই হবে মেঘে মেঘে বেলা কম হয়নি। সেই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের সেই সব দিন। যখন টিভি ছিল না (দু-একটা বাসায় সাদা-কালো বোকা বাক্স অবশ্য ছিল হয়তো, কে জানে।) মোবাইল ফোন ছিল না , এখনকার মতো টেকনোলজির এত হাঁকডাক ছিল না। সেই সময়ের ঈদ আর কেমন হবে।
কিন্তু না, স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে (কোভিড আক্রান্ত অনেকে বলছে তাদের নাকি মাঝেমধ্যে স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে! ইনক্লুডিং মি!!) তাহলে বলব আমাদের শৈশবের ঈদগুলো কিন্তু বেশ মজারই ছিল।
আগেই বলেছি আমাদের সময় টিভি ছিল না। এখনকার মতো টিভির সাত দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, তারকাদের টক শো এসব কিছুই ছিল না। পাগলের মতো শপিংমলে কেনাকাটা ছিল না। কোনো ম্যাগাজিনে ঈদসংখ্যায় প্রিয় লেখকের আনকোরা নতুন উপন্যাস ছিল না। না ভুল বললাম; যদ্দুর মনে পড়ে সেই সময় একটা ঈদসংখ্যা আমাদের বাসায় আসত। সেটা হচ্ছে বেগম পত্রিকার বিশেষ ঈদসংখ্যা। এমনি এই পত্রিকাটা ছিল ট্যাবলয়েড সাইজের পিন বাইন্ডিং। পাতা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু মনে আছে ভেতরে শেষের দিকে একটা পাতার অর্ধেকটা জুড়ে বিদেশি কার্টুন থাকত। সংলাপগুলো থাকত বাংলায় আমি খুব আগ্রহ করে দেখতাম। এখনো কিছু কিছু কার্টুনের স্মৃতি মনে আছে। কে জানে পরবর্তী জীবনে আমার কার্টুনিস্ট হওয়ার পেছনে বেগম পত্রিকার ওই আধা পাতার হয়তো একটা ভূমিকাও ছিল।
সে যা-ই হোক যা বলছিলাম... বেগমের ঈদসংখ্যাটা কিন্তু ওই সাইজে হতো না। ওটা হতো একটু ছোট অনেকটা ক্রাউন সাইজের, কিন্তু বেশ মোটাসোটা। এখনকার ঈদ সংখ্যা যেমনটা হয় আরকি। ওই পত্রিকায় বাসায় কেন আসত? বলতে গর্ব বোধ করছি, আমার মা ওই পত্রিকায় প্রায় নিয়মিতই গল্প লিখতেন (মাকে অবশ্য গল্পকার বানিয়েছিলেন আমার বাবা)। তো ওই ঢাউস পত্রিকাটা ঘরে আসার পর আমরা ছোটরা বিশেষ করে আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় বোন শিখু (সে এখন সব ঈদ আনন্দের ঊর্ধ্বে চলে গেছে) ঝাঁপিয়ে পড়তাম। না, আম্মার গল্প পড়ার জন্য না, গল্প পড়ার ধৈর্য কই? যাদের লেখা ছাপা হতো তাদের সবার একটা করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি প্রথমেই ছাপা হতো। সেখানে আম্মার ছবিটা খুঁজে বের করা হচ্ছে আমাদের প্রথম মিশন। ছবি পাওয়া মাত্র চেঁচামেচি করে সেটা নিয়ে ছুটতাম মার কাছে।
- আম্মা আম্মা আপনার ছবি!
আম্মা হয়তো রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। মাথা নাড়িয়ে বলতেন, ‘হ্যাঁ, পরে দেখব; রেখে দাও। ময়লা কর না।’ কিন্তু ময়লা না করে কি উপায় আছে? বাসার সবাইকে দেখিয়ে ছুটতাম পাড়ায়। পাড়ায় বন্ধুদের দেখাতে হবে না ঈদসংখ্যায় ছাপা হওয়া আমার আম্মার ছবি?
হ্যাঁ এভাবেই যেন আমাদের ঈদের আনন্দটা শুরু হতো।
তারপর ‘সীমিত’ আকারে কেনাকাটা। ছোটদের এবং মেয়েদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঈদের জামাকাপড় কেনাকাটা। একবার এমন হয়েছে সবার কমবেশি কেনাকাটা হয়েছে কিন্তু বড় ভাইয়ের জন্য কিছু কেনা হয়নি। সে ছোটবেলা থেকেই কিছুটা দার্শনিক টাইপের। ক্লাস এইটেই তার চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, দার্শনিক না হয়ে উপায় কী। বাবা খেয়াল করলেন সে মুখ গোঁজ করে আছে কোনো দার্শনিক চিন্তায় নয়। তার জন্য কিছু কেনা হয়নি তখন পর্যন্ত। সেই চাঁদরাতেই বাবা তাকে নিয়ে আবার বেরোলেন। এখনকার মতো তো আর রেডিমেড শার্ট পাওয়া যেত না মফস্বল শহরে। শেষমেশ তার জন্য একটা শার্টের কাপড় কেনা হলো। এই শর্তে যে ঈদের ছুটি শেষ হওয়া মাত্র পাড়ার দর্জির প্রথম কাজই হবে কাজলের শার্ট বানিয়ে দেওয়া। সে এতেই মহা খুশি! সেই শার্টের কাপড় পতাকার মতো হাতে নিয়ে সেই রাতেই বের হয়ে গেল বন্ধুদের দেখাতে। তারও একটা শার্ট হয়েছে। আহা কী সব দিন গেছে আমাদের।
কাজল বড় হয়ে লেখক হয়েছে। কোথাও এক জায়গায় লিখেছেন, ‘স্মৃতি সে সুখেরই হোক আর বেদনারই হোক, তা সব সময় বেদনার...।’ সত্যিই তাই, আমাদের শৈশবের সেই আনন্দের ঈদ এখন বেদনার ...!’