‘স্যার’ শব্দটা আমার মুখ থেকে সহজে [‘শিক্ষক’ ছাড়া] বের হয় না। সিরাজী ভাই ডিজি হয়ে আসার পরের দিন কথা হচ্ছে ফোনে। বললাম, সিরাজী ভাই স্যার-টার কিন্তু ডাকবার পারুম না। হা হা করে হেসে উঠে বললেন, আপনেরে কইছি স্যার ডাকতে? বললাম, মিটিং-টিটিং-এ দুয়েকবার কমুনে। হা, তাকে প্রকাশ্যে কিছুই ডাকি নাই। কিন্তু ফোনে তিনি বরাবরই ‘সিরাজী ভাই’ ছিলেন। বলতেন, আরে সরকার আমিন, আইছি, মহাপরিচালক আর কদিন? এরপরে তো সেই ফুটপাতে বইসা চা খাওয়ার সম্পর্ক। বলাবাহুল্য, তিনি স্যার হবার চেষ্টা করেন নাই। তিনি কবি ছিলেন। বলতেন প্রায়ই, আমলা না হয়া পারতেছি তো? বলতাম, পারতেছেন। প্রায় পৌনে তিন বছর তিনি বাংলা একাডেমিতে মহাপরিচালক ছিলেন। আমলা হননি। কবিই ছিলেন। কিন্তু সুদক্ষ নিষ্ঠায় দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন। সবাইকে নিয়ে সমবেতচেতনায় তিনি একাডেমি চালিয়েছিলেন। বলতাম— আপনি তো শুধু কবি না, প্রকৌশলীও! একটা অদ্ভুত ভালোবাসার বন্ধনে একাডেমির সবাইকে বেঁধে ফেলেছিলেন।
কয়েক দিনই তো আগের কথা। দুপুরে জরুরি খবর পাঠালেন, যেন অবিলম্বে দেখা করি। চিন্তিত হলাম। এত জরুরি কেন! মহাপরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করি; দেখি তিনি নাই। “এখানে আসেন আমিন” ডাক দিলেন। দেখলাম মহাপরিচালকের কক্ষের ভেতরে ছোট্ট বিশ্রাম চেয়ারে তিনি অর্ধশায়িত। বললেন, “মনের জোরে বেঁচে আছি। সর্ব অঙ্গে সমস্যা। ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরলাম। কাউরে কয়েন না।” বুঝলাম, মনটা হাল্কা করতেই আমার সাথে গল্প করতে চান। প্রাণ খুলে কথা বলতে শুরু করলেন। আমিও কিছু কথা বললাম। বললাম, মানুষের দেহ মরে, আত্মা মরে না। কারণ আত্মার কোনো জন্ম নাই, মৃত্যু নাই। তিনি শুনলেন, বললেন, রুমি অনুবাদ করার সময় বিষয়টা ভালো কইরা বুছছি।
এবার যেদিন হাসপাতালে গেলেন, সম্ভবত তার আগের দিন। ফোন করলাম। বললেন, বলেন। ‘উত্তরাধিকার’-এর পরের সংখ্যাটা শামসুজ্জামান খানকে নিয়ে করলে কেমন হয়?—জানতে চাইলাম। “সরকার আমিন, আগামী দুই মাস কে যে আমরা বাইচা থাকুম, ঠিক নাই। করেন। সংখ্যাটার কাজ শুরু কইরা দেন।”
কানে কথাগুলো বাজতেছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বোধহয় গন্তব্যের খবর জেনে গিয়েছিলেন।
ভালোবাসা, সিরাজী ভাই। গুডবাই, স্যার!