রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী নগরীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছে। গত ১৯ দিনে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে ৩ হাজার রোগী।
এদিকে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড না থাকায় মেঝে, বারান্দা ফাঁকা থাকলেই রোগী ভর্তি করাতে হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি চিকিৎসক কিংবা নার্স। ফলে ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি অন্যান্য রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, সে পরিমাণ কিংবা তার অর্ধেক রোগীও ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ছে না। এ কারণে পর্যাপ্ত বেড না থাকলেও ফ্লোরে রোগীদের ভর্তি নেয়া হচ্ছে। এতে হাসপাতালের চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০১ জন রোগী। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৬১৭ জন। তাদের মধ্যে ৫ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সরেজমিনে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির ২নং ভবনের ৬০১ নাম্বার ওয়ার্ডে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি রয়েছেন। যার মধ্যে ৭০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ফ্লোর ও বেডের পাশে খালি জায়গায় বিছানা করে। হাসপাতালটির ৩নং ভবনের মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডেও একই অবস্থা।
হাসপাতালটির প্রায় ৩০ জন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসাধীন অধিকাংশ রোগীর বসবাস কামরাঙ্গীর চর, কেরানীগঞ্জ ও সূত্রাপুরসহ এলাকায়। তাদের অধিকাংশই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
গেণ্ডারিয়া থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু কামরুজ্জামান রাজকে (১৩) মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করেছেন স্বজনরা। শিশুটির মা রাজিয়াল বলেন, তার জ্বর হয়। সঙ্গে শরীরের ব্যথা। বিকালে রক্ত পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়লে হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানে সিট না পাওয়ায় ফ্লোরে আছি। রাত থেকে ডাক্তাররা স্যালাইন দিয়ে রেখেছেন।
কেরানীগঞ্জের অপর একজন রোগীর স্বজন বাবুল উদ্দিন বলেন, ছোট ভাই রিয়াজের (২৫) জ্বর হওয়ার মাত্র ৫ ঘণ্টা পর রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে এলে সিট নেই বলে ডাক্তাররা অন্য দিকে যেতে বলে। অনেক অনুরোধ করে বেডের পাশে একটা বিছানা করে থাকার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের এখন সিটের দরকার নেই, দরকার চিকিৎসার।
হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের বাড়তি চাপে চিকিৎসায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ রোগীদের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসক তো বাড়ছে না।
মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক সময় সিট না থাকার কারণে রোগী ভর্তি করানোর মতো অবস্থা থাকলেও ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন সব হাসপাতালেই চাপ বেড়েছে। তাই যেখানেই একটু জায়গা আছে সেখানেই ফ্লোরে সিটের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালটিতে ৩০৯ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবার অধিকাংশ রোগীই ডেঙ্গুর ৩নং প্যাটার্নে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই প্যাটার্নের মূল ভূমিকা হলো আক্রান্ত রোগী আগেও আক্রান্ত হয়ে থাকলে সে এবার দ্রুত আক্রান্ত হবে। আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীদের রক্ত দিতে হচ্ছে। এজন্য জ্বর, ব্যথা, বমি বমি ভাব, শরীর দুর্বল বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলো দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও ডেঙ্গু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল আহসান বলেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মানুষ হঠাৎ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হলো তিনি এর আগেও হয়তো এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যে কারণে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার খুব দ্রুত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে ডেঙ্গুর ১ থেকে ৫টি প্যাটার্ন বা প্রকার থাকে। এবার অধিকাংশ রোগীই ৩নং প্যাটার্নে আক্রান্ত হচ্ছে। যার ফলে আগে দুই বা তিন দিন জ্বর থাকার পর ডেঙ্গুর সিনড্রম ধরা পড়তো; কিন্তু এবার তা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তা ধরা পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে গত এক সপ্তাহে যে পরিমাণ রোগী ভর্তি হয়েছে তা গত ৬ মাসেও ভর্তি হয়নি। তার কারণ এবার আবহাওয়ার পরিবর্তনটা একটু আগেই হয়েছে। গতবছর যেখানে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল জুলাই থেকে কিন্তু এবার তা মার্চ-এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছে। যে কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রুবায়েদ আমিন বলেন, এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই হেমারেজিক ফিভারে আক্রান্ত। তাদের অর্ধেকেরই শক সিন্ড্রোম। কারণ এবছর ডেঙ্গুর প্যাটার্নটা একেবারেই ভিন্ন। যে কারণে আক্রান্ত রোগীদের সবার প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে।
টিএইচ/একেএস