
৪ আগস্ট, রোববার বিকেল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে এসে থেমেছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ৯ বছরের ফুটফুটে শিশু শাকিলকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হয়ে এলেন তার বাবা কামাল হোসেন, মা ও দুই বোন। তারা সবাই পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা থেকে এসেছেন।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হাসপাতালের ট্রলিতে শাকিলকে ওঠানোর সময় দেখা যায় তার হাতে স্যালাইন লাগানো। মা আমেনা বেগম সেই স্যালাইন উঁচু করে ধরে আছেন। শিশু শাকিলের চোখ, মুখ, পেট ফুলে গেছে। দুটো ঠোঁট কালো হয়ে আছে। মনে হয় যেন আগুনে পুড়ে গেছে। শাকিল মৃদু স্বরে ‘আহ, উহ’ আর ‘মা’ ‘মা’ করছে।
জানতে চাইলে আমেনা বেগম দৈনিক জাগরণকে বলেন, ৭ দিন আগে ছেলেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। প্রথমে রাজধানীর মিরপুরের সেলিনা হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে ৬ দিন রাখার পর গতকাল শনিবার রাত ৯টার দিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে তাদের জানিয়ে দেন এ রোগীর চিকিৎসা তাদের হাসপাতালে হবে না। অন্য হাসপাতালে নিতে হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, ৬ দিনে ১৩ হাজার টাকা নিয়েছে ওই হাসপাতাল। এরপর যখন ছেড়ে দিয়েছে তখনও আরও ৯ হাজার টাকা দিতে বাধ্য করেছে। সেলিনা হাসপাতাল থেকে শাকিলকে এরপর আমরা কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকেও আজ আমার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বলেছে ঢাকা মেডিকেলে নিতে। এখন এখানে নিয়ে এলাম।
চোখের পানি মুছতে মুছতে শাকিলের মা জানান, শাকিলের প্লাটিলেট ১৮ হাজারে নেমে এসেছে। কিচ্ছু খেতে পারে না। এমনকী পানি পর্যন্তও খেতে পারে না। বাবা আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া কইরেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ও ডেঙ্গু আতঙ্কিতদের ভিড়ে দিশেহারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষ নয় রোগীরা বা রোগীদের স্বজনরাই যেখানে যেভাবে পারছেন হাসপাতালে স্থান করে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরান ভবন (মূল ভবন) ও নতুন ভবনের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিট সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়। এসময় রোগী ও অনেক রোগীর স্বজনদের আহাজারীও চোখে পড়ে।
আরো দেখা যায়, ঢামেকে ডেঙ্গু রোগীর সবচেয়ে ভিড় মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায়। দ্বিতীয় তলায় উঠতে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ওঠার সিঁড়ির একচিলতে স্থানও বাকি নেই যেখানে রোগী নেই। রোগীর স্বজনরা যে যেভাবে পারছেন সেখানে একটু স্থান নেয়ার চেষ্টা করছেন। রোগী ও রোগীদের স্বজনদের ভিড়ে হাসপাতালে চলাচল করাও অনেকটা মুশকিল। সব জায়গায় মানুষ আর মানুষ। হাসপাতালের ২০৮ ও ২০৭ নম্বর ওয়ার্ড ও এর চারপাশে (যেখানে একটু জায়গা আছে) শুধু রোগী আর রোগী। পাশাপাশি রয়েছেন আতঙ্কিত স্বজনরা।
২০৮ নম্বর ওয়ার্ডটি স্যাম ইউনিট হিসেবে পরিচিত। ওই ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা মোট ১৮টি। কিন্তু সেখানে রোগী রয়েছে কমপক্ষে দেড় শতাধিক। একেকটি বেডে কমপক্ষে তিন জন। কোনো কোনো বেডে ৪ জনও রোগী রয়েছেন। এদের সকলেই শিশু।
রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকা কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল এ্যাসিসটেন্ট বিজয় কুমার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢামেকে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। উদোম খালি গা ও পরনে লুঙ্গি। বিজয়ের সঙ্গে আসা তার বোন জানালেন, গত ৪/৫ দিন ধরে দাদার জ্বর। টেস্টে ডেঙ্গু পজেটিভ এসেছে। দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে এখানে নিয়ে এলাম।
স্যাম ওয়ার্ডে দেখা যায়, ছোট্ট মায়ের কোলে শিশু মারিয়ার হাতে ক্যানোলা (স্যালাইন পুশ করার জন্য নির্দিষ্ট কিট) দিয়ে স্যালাইন যাচ্ছে। মাত্র দেড় বছর বয়সী এ বাচ্চাটি যন্ত্রণায় অবিরাম কাঁদছে। কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন মা। পাশে দাঁড়ানো বছর পাঁচেক বয়সী আরেক মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর বাবা মেহেদী হাসান উঁচু করে স্যালাইনটি ধরে আছেন। অবস্থা এমন যে স্যালাইন ঝোলানোর স্ট্যান্ডও পাচ্ছেন না। কারণ একেকটি স্ট্যান্ডে আগে থেকেই একাধিক স্যালাইন ঝুলছে। অসহায় মা দীর্ঘক্ষণ কোনো বসার জায়গাও পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় পাশের বেডের এক রোগীর মহিলা স্বজন বসার জন্য একটি প্লাস্টিকের টুল এগিয়ে দিয়ে বলেন, আপনি আপাতত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসেন। টুলটি পেয়ে মারিয়ার মা কৃতজ্ঞ চোখে ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে বসে মেয়েকে বারবার চুমু দিতে থাকেন। বলতে থাকেন, ‘কাঁদে না সোনা, তুমি আল্লাহর রহমতে ভাল হয়ে যাবে’।
ঢামেকের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শত শত শিশু ও বিভিন্ন বয়সী রোগী ডেঙ্গু টেস্টের জন্য রক্ত দিচ্ছেন। অনেকে পরীক্ষার জন্য রক্ত দিতে দীর্ঘ অপেক্ষা করছেন। ডেলিভারি কাউন্টারের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। সেখানে গতকাল যারা টেস্ট করিয়েছেন, সেই টেস্টের রিপোর্ট নেয়ার জন্য ভিড় করেছেন।
দেড় বছরের শিশু আবু হোরায়রাকে নিয়ে তার বাবা ও মা গাজীপুর থেকে এসেছেন। হোরায়রার মা জানালেন, ছেলের ৫ দিন ধরে জ্বর। আজকে এখানে নিয়ে এলাম। এখন বাবুর রক্ত পরীক্ষার জন্য নিল। ‘দুই হাতেই তারা সিরিঞ্জ ঢুকিয়েছ ‘ বলেই কান্নায় মুখ ঢাকলেন মা।
ঢামেক কর্তৃপক্ষ থেকে জানা যায়, গতকাল শনিবার রাত ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত অথবা ডেঙ্গু আতঙ্কিত জ্বরের রোগী ঢামেকে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬৯৭ জন। আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল পর্যন্ত কত রোগী ভর্তি হয়েছে তা জানানো হয় রাত ৮টার পর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন জানান, গতকাল রাত ৮টা থেকে আজ সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ঢামেকে ভর্তি হয়েছে মোট ৬৯৭ জন।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি আছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য যেসব ওষুধপত্র লাগে এবং ডেঙ্গু পরীক্ষায় যেসব টেস্ট কিট লাগে তা আমাদের পর্যাপ্ত আছে। আতঙ্কের কিছু নেই।
হাসপাতালে রোগীদের ভিড়ের বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির বলেন, এখানে স্থান সংকুলান না হলে আমরা পাশের পুরো শেখ হাসিনা বার্ন হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করছি। তাই রোগীর ভিড় নিয়েও আমাদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
আতঙ্ক বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ঢামেকের পরিচালক বলেন, অনেকেই হাসপাতালে আসছেন আতঙ্কিত হয়ে। জ্বর জ্বর ভাব, পাতলা পায়খানা ও পেটে ব্যথা নিয়েও অনেকেই আসছেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। হয়ত এদের অনেকেরই ডেঙ্গু জ্বর হয়নি। আমরা দেখেছি প্রায় ৬শর মতো টেস্ট করে কখনও ৪০/৪৫ জন ডেঙ্গু পজেটিভ ধরা পড়েছে। কিন্তু এত মানুষের টেস্ট করতে আমাদের জনবল কাজে লাগাতে হয়েছে। হাসপাতালে স্থান দিতে হয়েছে। টেস্ট কিট ব্যবহার করতে হয়েছে। সময় দিতে হয়েছে। এতে চাপ বেড়েছে। তাই আমরা বলছি, জ্বর জ্বর ভাব, পাতলা পায়খানা ও পেটে ব্যথা হলেই আতঙ্কিত হওয়া কিছু নেই। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরা পরীক্ষার জন্য না বললে আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে চাপ না বাড়ালে প্রকৃত রোগীরা আরও ভাল সেবা পেতে পারেন।
টিএস/ টিএফ/ এফসি