• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২০, ১১:৫২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৮, ২০২০, ১১:৫২ এএম

ঢাকাকে গিলছে করোনা

ঢাকাকে গিলছে করোনা

আগের দিন নমুনা পরীক্ষায় যেখানে ৩৪১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন, সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৫ জন কম রোগী পাওয়া গেছে। তবে এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৬০ থেকে লাফিয়ে বেড়ে ৭৫ হয়েছে। আক্রান্তের দিক দিয়ে ঢাকাকে গিলছে করোনা। এরপরই থাবা বসিয়েছে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের দিকে।

তবুও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সবাই ঘরে থাকলে এই এপ্রিলেই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অঙ্কের এমন ফর্মুলা আর সারাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কতটুকু মিল রয়েছে তা নিয়ে সব মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদদের অনেকের মতে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ ধরনের সহজ হিসাব করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তারা বলছেন, অঙ্কের ফর্মুলায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সফল হলেও বাস্তবে ঢাহা ফেল করেছেন।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার ২ হাজার ১৯টি নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৩৪১ জন, মারা গেছেন ১০ জন। আর গতকাল শুক্রবার ২ হাজার ১৯০টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ২৬৬ জন, মারা গেছেন ১৫ জন। শনাক্ত রোগী সংখ্যা কমে এলেও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, করোনা ছাড়াও তাদের শরীরে অন্য উপসর্গ ছিল।

তবে করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে আরো বেশি টেস্ট করার দিকে জোর দিচ্ছে সরকার। তীব্র শ্বাসকষ্ট বা করোনা সংক্রান্ত অন্য লক্ষণ দেখা দিলে এখন আর দেরি না করে সবারই পরীক্ষা করা হচ্ছে। সরকার এও বলছে, করোনা আক্রান্ত ৮০ ভাগ মানুষেরই কোনো ওষুধের দরকার পড়ে না। আর কারো ওষুধ দরকারহলে, তা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার ওপর। তবে কারো শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়া থাকলে তার চিকিৎসা দিতে হবে। খুব কম সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এই যখন অবস্থা তখনো অনেক রোগীই বলছেন, টেস্ট এখনো দ্রুত হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বহুবার ফোন করার পরই টেস্ট করার জন্য নমুনা দিতে পারছেন। এতে রোগীর মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যতই বলছেন, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা উপকরণ দেয়া হয়েছে; ততই চিকিৎসকদের আক্রান্তের পরিমাণ বাড়ছে। এ পর্যন্ত ৯০ জন চিকিৎসক ও ৫৪ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু, ২৪ ঘণ্টায় ১৫ জন : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ২৬৬ জন। গত কয়েকদিন ধরেই মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। সবমিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ৭৫ জন। গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব তথ্য জানান। গেল ২৪ ঘণ্টায় মোট ২ হাজার ১৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে ২৬৬ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ হাজার ৮৩৮ জনে। এর বিপরীতে নতুন করে ৯ জন সুস্থ হয়ে ওঠায় মোট সুস্থের সংখ্যা ৫৮ জন।

রোগীর চিকিৎসা দুর্লভ, আক্রান্ত ৯০ স্বাস্থ্যকর্মী : হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসা সহজলভ্য নয়, এর পাশাপাশি ভেঙে পড়েছে অন্য রোগবালাইয়ের চিকিৎসাও। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার চিকিৎসার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা কাজে নিয়োজিতদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তারা আরো বলেন, চিকিৎসকরাই এখন করোনা হুমকির মুখে আছেন। তারা যদি রক্ষা না পান তাহলে চিকিৎসা চলবে কীভাবে!

দেশে এ পর্যন্ত ৯০ জন চিকিৎসক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মো. মঈন উদ্দিন নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন একজন। হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫৩ জন। আর তিনজন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাকিরা বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরূপম দাশ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছের রাজধানী ঢাকায় ৫০ জন। এরপর নারায়ণগঞ্জে ১২ জন, ময়মনসিংহে সাতজন এবং গাজীপুরে ছয়জন। বাকিরা দেশের অন্যান্য জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে কোয়ারেন্টাইনে আছেন প্রায় ৩০০ স্বাস্থ্যকর্মী।

এদিকে সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটস সংগঠনের মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ বলেছেন, দেশে ৫৪ জন নার্স করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালের ২৮ জন। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ২৬ জন। এছাড়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এমন ২৫০ থেকে ৩০০ নার্স কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

টেস্ট এখনো জটিল : সরকার যতই বলছে বেশি করে টেস্ট করাতে কিন্তু বাস্তবে এই টেস্ট বহু কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কথায় করোনা আক্রান্ত সন্দেহ হলে টেস্ট এখনো জটিল ও কঠিন। ১৪ এপ্রিল করোনা পজিটিভ হওয়া এক গণমাধ্যমকর্মী জানান, তিনি পাঁচ দিন চেষ্টার পর করোনা টেস্ট করাতে সক্ষম হয়েছেন। ওই পাঁচ দিন তিনি আইইডিসিআর ও বিএসএমইউতে দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন করোনা পজিটিভ হওয়ার পর বাসায়ই আছেন আইসোলেশনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাকে একটি টেলিফোন মেসেজ দিয়ে আলাদা থাকতে বলেছে। তিনি বলেন, পুলিশ যোগাযোগ করছে। কিন্তু আমার চিকিৎসা কোথায় হবে আমি জানি না।

এখন ঢাকায় নয়টি ও ঢাকার বাইরে ছয়টি করোনা টেস্ট সেন্টার আছে বলে প্রচার করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

দেশের সিংহভাগ করোনা রোগী বাসায়, ৩০ শতাংশের মতো হাসপাতালে : চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও হয়রানি এড়াতে দেশের করোনা শনাক্ত রোগীদের সিংহভাগই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, দেশে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে এমন রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৩৮ জন।

এর মধ্যে ৫০০-এর কিছু বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। বাকিরা বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী বাসায় থেকে আর ৩০ শতাংশের মতো রোগী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

একই ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বুলেটিনে বলেন, যারা এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের সবার হাসপাতালে থাকার দরকার ছিল না। অনেকেই সামাজিক চাপে বাসা থেকে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিচ্ছে। যারা মৃদু উপসর্গের রোগী তারা বাসায় থেকে আইসোলেশন মেনে চললে অপেক্ষাকৃত জটিল রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া সহজ হবে। আইইডিসিআর পরিচালক জানান, আক্রান্তদের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়স ২১ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ১৯ শতাংশ এবং ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সের ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ৫৫ শতাংশের বয়স ২১ বছর থেকে ৫০ বছর। বুলেটিনে আরো জানানো হয়, আক্রান্ত বাংলাদেশিদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ আর ৩২ শতাংশ নারী।

আক্রান্তের ৪৬ শতাংশই ঢাকায় : আক্রান্তদের মধ্যে ৪৬ শতাংশই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। এরপর ২০ শতাংশ নারায়ণগঞ্জের। এছাড়া গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও মুন্সীগঞ্জেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। রাজধানীর মধ্যে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা মিরপুরে সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ। করোনা ভাইরাস প্রথমে টোলারবাগে শনাক্ত হলেও এখন তা মিরপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর মোহাম্মদপুর, ওয়ারী ও যাত্রাবাড়ীতে ৪ শতাংশ করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া ধানমন্ডিতে ৩ শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে।

এওয়াই/এসকে

আরও পড়ুন