ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো জ্বর। অনেকেই ভাইরাল জ্বর বলে এটি অবহেলা করেন। আর সে কারণেই ডেঙ্গু ভয়াবহ হতে পারে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ডেঙ্গু জ্বর আর ভাইরাল জ্বর একে অপরের থেকে আলাদা হলেও ডেঙ্গু তুলনামূলকভাবে ভয়ংকর। প্রাথমিক লক্ষণগুলো একই হওয়ার কারণে আপনি ঠিক কী রোগে ভুগছেন, তা প্রথম অবস্থায় বোঝা কঠিন হতে পারে।
এডিস মশা কামড় দিলেই কি ডেঙ্গু হয়?
এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, এডিস মশা কামড় দিলেই ডেঙ্গু হবে না। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবেশে উপস্থিত কোনো ভাইরাস যদি কোনো এডিস মশার মধ্যে সংক্রমিত হয়, শুধুমাত্র তখনই ওই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্ত্রী এডিস ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে এরা ভাইরাস ছড়াতে থাকে।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্য জনে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে।
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে। তবে অন্ধকারাছন্ন পরিবেশে দিনের যে কোন সময় কামড়াতে পারে। এডিস মশা অপেক্ষাকৃত আকারে বড়, লম্বা পায়ে ডোরা কাটা থাকে।
এডিস মশা কীভাবে চিনবেন?
একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই যে কেউ ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশাকে খালি চোখেই চিনতে পারবেন। মাঝারি আকারের সাদা-কালো ডোরাকাটা এই মশার শুঁড় থাকে লোমযুক্ত। এদের মাথার পেছনের উপরের দিকেও একটি সাদা দাগ থাকে, তাই সাধারণ মশা থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়।
কাল-থেকে সন্ধ্যা, সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত সময়ে এডিস মশার কামড় দেয়। সাধারণত সকালের প্রথম দিকে এবং সন্ধ্যার ঠিক কিছুটা আগে এডিস মশা তৎপর থাকে। অনেকেই আবার ভাবেন, এডিস মশা বোধহয় শুধু পায়েই কামড়ায়। এটাও এক ধরনের ভুল ধারণা। পায়ের অংশ শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় উন্মুক্ত থাকে বলে, ওই জায়গাকেই এরা কামড়ানোর জন্য বেছে নেয়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি, কিভাবে বুঝবেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন?
ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর এবং হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর। প্রকার অনুসারে লক্ষণ ভিন্ন হয়ে থাকে। ভারতের কলকাতা মেডিক্যাল রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের ইন্টারনাল মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. রাজশ্রি সেনগুপ্তা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের কোন বিশেষ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে।
সঠিক চিকিৎসায় বাড়িতে থেকেই এই রোগের নিরাময় করা সম্ভব। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই রোগীকে হসপিটালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রেও এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভাল হয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না। এটিকে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুই হিসাবে বলা হয়ে থাকে। শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়। ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ গুলো হলো-
উচ্চ জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), তীব্র মাথার যন্ত্রণা, চোখের পেছনে ব্যথার অনুভূতি, মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধিতে যন্ত্রণা, বমিভাব, মাথাঘোরা, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ত্বকে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি দেখা দেয়া।
এই উপসর্গ গুলি রোগ সংক্রমণের চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। সাধারণত দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত উপসর্গ স্থায়ী হতে পারে। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগের ভয়াভয়তা বৃদ্ধি পায়। সে কারনে পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সতর্কতা মেনে চলতে বলা হয়। এই ধরনের ডেঙ্গুকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর বলা হয়ে থাকে।
ডেঙ্গুর গুরুতর উপসর্গগুলো হলো- প্রচণ্ড পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি হওয়া, মারি বা নাক থেকে রক্তপাত, প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত, অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (যা ক্ষতের মতো দেখাতে পারে), দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, ক্লান্তি, বিরক্তি এবং অস্থিরতা।
ডেঙ্গু জীবাণু মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তনালীতে ছিদ্র তৈরি হয়। রক্ত প্রবাহে ক্লট-তৈরির কোষগুলোর (প্ল্যাটলেট) সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এর জন্য মানুষের শরীরে শক লাগা, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, যে কোন অঙ্গের ক্ষতি এবং শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
রোগীর শরীরে গুরুতর উপসর্গগুলো কোন একটি দেখা দিলে অতি অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত বা রোগীকে নিকটবর্তী হসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। অন্যথায় রোগীর প্রাণ সংকট হতে পারে। সবচেয়ে ভালো গুরুতর লক্ষণের শুরুতে সতর্ক হওয়া।
ডেঙ্গুতে প্লেটলেটের সংখ্যা সাধারণত কত হয়?
স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান একজন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের প্লেটলেট সংখ্যা হয় দেড় থেকে সাড়ে চার লাখ প্লেটলেট প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে। উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীদের এই সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে চলে যেতে পারে। এই সময় রক্তপাতের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হয়। মাঝারি ঝুঁকি পূর্ণ রোগীদের প্লেটলেট সংখ্যা ২১ থেকে ৪০ হাজার থাকে।
অবশ্য ডেঙ্গু সংক্রমণে অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটলেট সংখ্যার দ্রুত পরিবর্তন হয়। প্লেটলেট কাউন্ট কম এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তবেই প্লেটলেট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। সংক্রমণ কমার সাথে সাথে আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে প্লেটলেট কাউন্ট বৃদ্ধি পায়।
ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের জন্য ডায়েট
ডেঙ্গু রোগীদের প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি (সাইট্রাস ফল, বেরি এবং শাক-সবজিতে পাওয়া যায়), জিঙ্ক (সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি এবং বাদামে পাওয়া যায়), আয়রন (মাংস, মটরশুঁটিতে পাওয়া যায়), ওটমিল (সহজপাচ্য কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ), পেঁপে, ডাবের পানি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ফোলেট এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহন।
সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে পানি ন করা দরকার শরীরকে হাইড্রেট করার জন্য। আর সহজে হজম হয়না এমন খাবার ডেঙ্গু রোগী দের খাওয়া উচিত নয়। যেমন- আমিষ খাবার, চর্বি, তৈলাক্ত খাবার এবং ভাজাভুজি জাতীয় সব ধরনের খাবার।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের উপায়
ডেঙ্গু একটি মশা-বাহিত রোগ। তাই মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেকে এবং আপনার পরিবার কে বাঁচান। বাড়ির চারপাশে পানি জমতে দেবেন না। জমা পানি মশার বংশবিস্তার করে। পানি জমতে না দিয়ে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সপ্তাহে অন্তত একবার পানি জমতে পারে এমন জায়গা পর্যবেক্ষণ করুন। এবং গাছের টব, ফুলদানি, পরে থাকা গাড়ির টায়ারের জমে থাকা পানি ফেলে দিন। শরীর ঢাকা জামা কাপড় যেমন লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং জুতা পরুন।
ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন। রাতে শোবার সময় মশারি ব্যবহার করুন। মশা নিরোধক কেমিক্যাল যেমন পারমেথ্রিন ব্যবহার করুন। নগরবাসীকে এ সময় সজাগ ও সচেতন হতে হবে।
ডেঙ্গু হলেই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকা উচিত। কিছু বিপদ সংকেত জানা থাকলে সতর্ক হতে সুবিধা হবে। গুরুতর কোন লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে থেকে কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না। কারণ ভুল ওষুধ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ?
ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে অথবা এক বিছানায় ঘুমালে কিংবা তার ব্যবহৃত কিছু ব্যবহার করলে, অন্য কারো এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসায় কোনো বাধা নেই, কিংবা তাকে আলাদা রাখার কোনো প্রয়োজনও নেই। তবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখাই উত্তম।
জাগরণ/স্বাস্থ্য/ডেঙ্গু/এসএসকে