চীন প্রস্তাবিত প্রত্যর্পণ আইনের বিরুদ্ধে হংকং-এ সংঘঠিত বিক্ষোভটি কঠোর হস্তে দমন করেছে দেশটির পুলিশ। বুধবার(১২ জুন) হংকংয়ে এ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে সমবেত বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট, কাঁদুনে গ্যাস এবং পিপার (মরিচের গুঁড়া) স্প্রে নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এসময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে প্রায় ৭২ জন বিক্ষোভকারী এবং ২১ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আহত হন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও ১১ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে হংকং পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, বুধবারের পুলিশি অ্যাকশনের পর রাজপথে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে। পুরো হংকং জুড়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। বিক্ষোভকারীদের দাবি, তাদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী। উত্তেজনা অনেকটা কমে এলেও এখনো ঐ সব অঞ্চলে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এখন বিক্ষোভ-সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ সরানোর কাজ করা হচ্ছে।
বুধবার (১২ জুন) প্রস্তাবিত ঐ আইনের বিষয়ে হংকংয়ের পার্লামেন্টে আলোচনার কথা থাকলেও আন্দোলনের জন্য তা স্থগিত করা হয়। প্রস্তাবিত আসামি প্রত্যর্পণ আইন পাশ করার জন্য আইন প্রণেতাগণ যাতে পার্লামেন্ট হাউজে প্রবেশ করতে না পারেন সে কারণেই প্রধান সরকারি ভবনগুলোর প্রবেশ পথে অবস্থান নিয়ে সেগুলো অবরুদ্ধ করে রাখে বিক্ষোভকারীরা।
হংকংয়ের নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর এমন বর্বর আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মুখপাত্র বলেন, হংকংয়ের শান্ত-নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর এই আক্রমণ সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত। এই সমস্যার শান্তিপ্রিয় সমাধানের জন্য আমরা প্রত্যেক দলকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানাচ্ছি। রয়টার্স
হংকংয়ের মোট জনসংখ্যা ৭৬ লাখ। এই অঞ্চলে নেতা নির্বাচনের জন্য ১২০০ জন প্রতিনিধির একটি কমিটি রয়েছে যাদের ভোটে নেতা নির্বাচিত হয়। তাদের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্যারি লাম।
'এক দেশ, দুই প্রশাসনিক ব্যবস্থা'। সাবেক ব্রিটিশ কলোনি এবং বর্তমানে চীনের অধীনে থাকা আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের জন্যই এই উক্তিটি প্রযোজ্য। ১৫০ বছর ব্রিটিশদের অধীনে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই এক চুক্তিতে ব্রিটেন হংকংকে ৫০ বছরের জন্য অর্থাৎ ২০৪৭ পর্যন্ত চীনা প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করে।
এই চুক্তিতে হংকংয়ের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আইনি অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে চীন প্রশাসনের চাপিয়ে দেওয়া বহিঃসমর্পণ প্রত্যর্পণ আইনের কারণে তাদের এই অধিকার হুমকির মুখে পড়েছে। হংকং ২০টি দেশের সাথে বহিঃসমর্পণ আইনে চুক্তিবদ্ধ হলেও চীনের সাথে বিগত দুই দশক ধরে সমঝোতা না হওয়ার কারণেই এই আইনে চুক্তিবদ্ধ হয়নি বলে জানা যায়।
অপর দিকে, এই আইনের পক্ষে চীনাপন্থি আইনপ্রণেতাদের বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল, কোনো অপরাধী এক ভূখণ্ডে অপরাধ করে অন্য ভূখণ্ডে গিয়ে যাতে বিচারের আওতাহীন না থাকতে পারে এজন্য এই সংশোধনী আনা হয়েছে। এই আইন সংশোধনী নিয়ে ১১ মে হংকং পার্লামেন্টে সংশোধনীর পক্ষে ও বিপক্ষের আইন প্রণেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছিল।
তবে বিক্ষোভকারী ও সমালোচোকদের দাবি প্রস্তাবিত এই আইন পাশ হলে হংকং তার বিচারিক স্বাধীনতা হারাবে এবং হংকংয়ের যে কোনো মানুষকে অভিযুক্ত করে খুব সহজেই চীনের মূল ভূমিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অভিযুক্তদের ওপর নির্যাতন এবং যে কোনো ধরনের অভিযোগের অযৌক্তিক বিচার রায় চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এই আইন পাশ হলে হংকংয়ের বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হংকংয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীনের হস্তক্ষেপ বাড়বে। এছাড়াও এই আইনের ফলে বিশ্ব বাজারে বাণিজ্যিক আকর্ষণ হারাবে হংকং এবং হংকংয়ের প্রতি আস্থা হারাবেন বিনিয়োগকারীরা।
তবে সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যারি লাম বলেছিলেন, এই আইনের প্রয়োজন রয়েছে এবং এতে মানবাধিকারের রক্ষাকবচগুলো যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে তোলা হয়নি। বিবেকের তাড়নায় এবং হংকংয়ের প্রতি অঙ্গীকার থেকেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।
হংকং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বিক্ষোভের কারণে প্রস্তাবিত আইনের কিছু দিক স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্তরা এই আইনের আওতাধীন থাকবে না। এই আইন প্রত্যর্পণ করা হয়েছে যাতে কেও এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে গিয়ে হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ করে আইনের নাগাল থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে না পারে।
এসকে