সাম্প্রতিক বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে সৌদি আরব ও ইরানের বৈরিতা। যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিরাজমান সংকটাপন্ন পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে। নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এ অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সৌদি আরব ও ইরানের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রমেই সংঘাত ও সহিংসতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এই বিষয়টি গোটা আরব সাম্রাজ্যের পতনের পথকে বিস্তৃত করছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট নিরসনে এখনই সক্রিয় না হলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কঠিন হুমকির মুখে পড়বে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অস্তিত্ব। আর এর ফলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সন্ত্রাসবাদের ভয়াল বিস্ফোরণ ঘটবে, যাকে পুঁজি করে গোটা বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে অন্তিম সাফল্য অর্জন করবে মানবতাবিরোধী অপশক্তি।
বিশ্ব গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণাত্মক মতামতের আলোকে বলা যায়, আরব বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ দুটির মধ্যে কয়েক দশক ধরে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, এর মূলে রয়েছে ধর্ম, তেল আর আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আরব সাম্রাজ্যের এই ক্ষমতাধর রাষ্ট্র দুটির মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছানোর পেছনে প্রত্যক্ষ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ও সম্প্রতি ইসরায়েলের সম্পৃক্ততা।
এক নজরে দেখে নেয়া যাক সৌদি আরব ও ইরানের মাঝে বিদ্যমান এই বৈরিতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও নেপথ্যের বিশেষ কারণগুলো-
• তেল :
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক পণ্যটির দাম বেশি বাড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলপন্থী দেশগুলোর ওপর অবরোধ আরোপ করে। ইরান তার উচ্চাভিলাষী শিল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেলের দাম বাড়াতে মরিয়া ছিল। অন্যদিকে সৌদি আরব তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এর বিরোধিতা করে।
• ইরানি বিপ্লব :
পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে ইরানে ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ অঞ্চলের দেশগুলোর অভিযোগ- ইরান নিজেদের বিপ্লব তাদের দেশে রফতানির চেষ্টা করছে।
• ইরান-ইরাক যুদ্ধ :
১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাক ইরানের ওপর হামলা চালায়। এতে যুদ্ধ বেঁধে যায়, যা স্থায়ী হয় ৮ বছর। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেনকে আর্থিক সহায়তা দেয় সৌদি আরব। অন্য সুন্নি উপসাগরীয় দেশগুলোকেও ইরাকের পক্ষ নিতে উৎসাহিত করে রিয়াদ।
• মক্কায় ভয়াবহ অভিযান :
১৯৮৭ সালের জুলাইয়ে ইরানি হাজীরা মক্কায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করে। এটা দমন করে সৌদি আরব। এতে প্রায় ৪০০ লোক মারা যায়, যাদের বেশিরভাগই ইরানি। ক্ষুব্ধ ইরানিরা তেহরানে ১৯৮৮ সালের এপ্রিলে সৌদি দূতাবাসে লুটপাট চালায়। সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত ইরানিরা আর হজে যায়নি।
• সম্পর্কের উন্নতি :
১৯৯৭ সালের মে মাসে ইরানের সংস্কারপন্থী নেতা মোহাম্মদ খাতামি প্রেসিডেন্ট হলে দুদেশের সম্পর্কে উন্নতি ঘটে। ১৯৯৯ সালের মে মাসে ঐতিহাসিক সফরে তিনি সৌদি আরব যান। তবে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকে আগ্রাসন চালালে নতুন করে উত্তেজনা দেখা যায়। সাদ্দামের পতনের পর ইরাক ইরানি প্রভাব বলয়ে ফিরে আসে।
• আরব বসন্ত :
মধ্যপ্রাচ্যে ২০১১ সালে আরব বসন্তের তীব্রতা বেড়ে যায়। রিয়াদ প্রতিবেশী দেশ বাহরাইনে সেনা পাঠায়, ফলে শিয়া সংখ্যালঘুদের বিক্ষোভ ভণ্ডুল হয়। সুন্নি শাসিত দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য তেহরানকে অভিযুক্ত করে রিয়াদ। সিরিয়া গৃহযুদ্ধ নিয়ে ২০১২ সালে আবারও মুখোমুখি হয় রিয়াদ ও তেহরান। ইরান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সামরিক রসদ পাঠায় এবং সুন্নি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইরান। অন্যদিকে সৌদি আরব বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানায়। ২০১৫ সালের মার্চে শুরু হওয়া ইয়েমেন যুদ্ধেও একে অপরের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব ও ইরান। ইয়েমেনি প্রেসিডেন্টকে সহায়তা দিতে সুন্নি আরব জোট গঠন করে রিয়াদ এবং শিয়া ‘হুথি বিদ্রোহী’দের সমর্থন দেয় তেহরান।
• হজে হতাহত :
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে হজ চলাকালীন আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় ইরানের কয়েকশ নাগরিকসহ ২ হাজার ৩০০ বিদেশি হজযাত্রী নিহত হন। এসময় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনি বলেন, ‘ইসলামের পবিত্র এ স্থানটির সঠিক তদারকি করতে ব্যর্থ সৌদি ক্ষমতাসীন রাজপরিবার।’
• ধর্মীয় নেতার ফাঁসি :
সৌদি সরকারবিরোধী বিক্ষোভের অভিযোগে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রখ্যাত শিয়া ধর্মীয় নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এতে তেঁতে ওঠে ইরান। তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা। তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ।
• হিজবুল্লাহ :
২০১৬ সালের মার্চ মাসে ইরানের মিত্র ও লেবাননের শক্তিশালী শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ‘সন্ত্রাসী’ তালিকাভুক্ত করে সৌদি আরব। সেসময় রিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে হিজবুল্লাহ প্রধান বলেন, সুন্নি ও শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বিদ্রোহ’ তৈরিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সৌদি আরব। চলতি মাসে সৌদি আরব থেকেই লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। হিজবুল্লাহর সহায়তায় ইরান দেশটির দখল নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
• কাতার সংকট :
সন্ত্রাসবাদে মদদ ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে চলতি বছরের জুন মাসে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলো।
• পরমাণু চুক্তি :
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ রাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করে ইরান। গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিলে সৌদি আরব তার কঠোর নীতির প্রতি সমর্থন জানায়।
এসকে/ এফসি