যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মার্কিনিদের অভিবাসন ঠেকাও নীতির বলি, এক বাবা ও তার শিশু কন্যার সলিল-শায়িত মরদেহের মর্মান্তিক এক ছবি লাঞ্চিত করলো গোটা বিশ্বের মানবতাকে, প্রশ্নবিদ্ধ করলো আধুনিক পৃথিবীর মানব সভ্যতাকে। ভূমধ্যসাগরের তীরে পড়ে থাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার উদ্বাস্তু শিশু আলান কুর্দির ছবি ঝাপসা হওয়ার আগেই আরেক মর্মান্তিক মৃত্যুর ছবি সামনে এলো। এবার এই অসহায় উদ্বাস্তু পিতা ও তার শিশু কন্যার মৃত্যুর ছবিতে তোলপাড় হলো গোটা বিশ্ব। উদ্বাস্তু সমস্যা কীভাবে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের, সেই বিভীষিকাময় সত্যের দিকে আবারও দৃষ্টিপাত করছে ছবিটি।
বুধবার (২৬ জুন) আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিও গ্র্যান্ডে এলাকার। এই অংশে মেক্সিকোর সঙ্গে সীমানা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মেক্সিকোর এক সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, মৃত ব্যক্তির বাড়ি মেক্সিকোর এল সালভাদরে। নাম অস্কার অ্যালবার্তো মার্টিনেজ রমিরেজ ও সাথের ছোট্ট প্রাণহীন দেহটি তার মেয়ে ভ্যালেরিয়ার।
মৃত অবস্থায় পানিতে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা ওই ব্যক্তি ও তার শিশু কন্যার ছবিটি প্রকাশ মাত্র ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে বিশ্ব গণমাধ্যমে। ছবিতে দেখা যায়, পানিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে রমিরেজের লাশ আর তার টি-শার্টের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে রয়েছে শিশু ভ্যালেরিয়া। তার একটি হাত বাবার টি-শার্টের গলার কাছ দিয়ে বেরিয়ে গলায় জড়িয়ে রয়েছে।
দেহগুলো খুঁজে পাওয়ার পর একটি মেক্সিকান সংবাদপত্র প্রথম সোমবার (২৪ জুন) সেই খবর প্রকাশ করে। তারপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই ছবি। সংবাদপত্রটি জানিয়েছে, ওই পরিবার মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। তা না পেয়ে হাতাশ হয়ে পড়েছিল। পরে অবৈধভাবে বিপদসঙ্কুল জল পথ ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে এই মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করে।
প্রকাশিত খবরের তথ্য মতে জানা যায়, গত রোববার মেয়েকে নিয়ে নদী পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের প্রচেষ্টা চালায় উদ্বাস্তু এই পরিবারটি। প্রথমে মেয়েকে নদীর পাড়ে বসিয়ে রেখে ফের নিজের স্ত্রীকে আনতে জলে নামেন রমিরেজ। কিন্তু মেয়ে ভ্যালেরিয়া বাবাকে ছাড়তে চাইছিল না। সেও নদীতে ঝাঁপ দেয়। এরপরই ঘটে বিপত্তি। মেয়েকে খরস্রোতা নদীর বুক থেকে তুলতে গেলে প্রবল স্রোতের টান তাদের দুজনকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর তাতেই মৃত্যু হয় দুজনের। পরে এভাবেই বাবা-মেয়ের মরদেহ ভেসে উঠে পাড়ে এসে ঠেকে।
২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে ইউরোপে প্রবেশ করতে চেষ্টা চালায় একদল সিরিয় উদবাস্তু। সে সময় মৃত্যু হয় সিরিয়ার তিন বছরের শিশু আলানের। উদ্বাস্তু সমস্যার সেই ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। আর এবার জীবনের তাগিদে ভিটামাটি ছেড়ে আসা রেমিরেজ পরিবারের ভাগ্যে জুটলো এই করুণ পরিণতি, যা থেকে ছাড় পায়নি শিশু ভ্যালেরিয়াও। মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে গিয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয় প্রতি বছর। শুধু গত বছরই ২৮৩টি মৃত্যুর খবর মিলেছে।
বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যখন ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বেপরোয়া যুদ্ধনীতিতে মজেছে। ঠিক সে সময় তাদের আগ্রাসনে এমনভাবেই লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন পরিণত হচ্ছে ভাসমান উদ্বাস্তুতে। কিন্তু তাদের পুনর্বাসন বা শরনার্থী সহযোগিতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথাই নেই বিশ্বপতিদের। অথচ সমরাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন ও পরীক্ষামূলক কাজে প্রতি বছরই কয়েক বিলিয়ন ডলার পুড়ে ছাই হচ্ছে ঝাঁঝালো বারুদের সঙ্গে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কট্টর অভিবাসী নীতি দক্ষিণ আমেরিকার উদ্বাস্তুদের এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে বহুবছর ধরেই। বিশ্বজুড়ে মার্কিন মদদপুষ্ট যুদ্ধবাজ দেশগুলোর সামরিক আগ্রাসনে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন আর লেবাননের মত দেশগুলো আজ কেবলই ধ্বংস্তুপ। একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরানের আর্থ-সামাজিক স্থিতি। ক্রমেই কোমর ভেঙে পড়ছে মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলার মত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি। তবু যেন এই দাম্ভিক বোধহীন মানুষটির হুঁশ ফেরে না!
মার্কিন কংগ্রেস ও দেশটির মানুষের মানবিক দাবিকে তোয়াক্কা না করে, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্তে এখনও অটল ডোনাল্ড ট্রাম্প। হয়তো আরো লাশের বিনিময়েও তা বদলাবে না। তবে নির্মম সত্য হচ্ছে, এমন আয়লান আর ভ্যালেরিয়াদের বিভীষিকাময় মৃত্যুর জবাব একদিন দিতেই হবে মানবতার হন্তক, এই কথিত বিশ্ব প্রভুদের।
এসকে