ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব ঘিরে তুমুল অস্থিতিশীলতার মাঝে শনিবার মধ্যরাতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ব্যতিক্রমী তৎপরতা দেখা গেছে। সেই সময়ে কিছু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ইমরানের বাসভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে এসবের কিছু হয়েছে ক্যামেরার সামনে এবং বেশিরভাগই রুদ্ধদ্বার।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির উর্দু বিভাগ শনিবার মধ্যরাতে হঠাৎ ইমরানের বাসভবনে সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এবং তার পরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, শনিবার দিনভর অনাস্থা ভোটের কার্যক্রমের কেন্দ্রে ছিল সংসদ ভবন। সংসদে মাঝে মাঝে বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়।
তারপর দফায় দফায় অধিবেশন মুলতবি করা হয়। সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা স্পিকারের সাথে আলোচনা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কয়েকবার মুলতবি হয়ে যাওয়ার পর বিরোধীরা তাদের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেন।
কিন্তু সন্ধ্যায় যখন ইফতারির জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করা হয়, তখন হঠাৎ করেই যাবতীয় কার্যক্রমের কেন্দ্র হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বাসভবন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার আইনি ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং কিছু আমলাসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের জরুরি বৈঠক ডাকেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্র করেছে বলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একটি নথির কথা তুলে ধরেন। এ সময় দেশটির কিছু কর্মকর্তার কাছে ওই নথি প্রকাশের অনুমোদন দেওয়া হয় বৈঠকে।
এদিকে, জাতীয় পরিষদের স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার ইমরান খানের বাসভবনে পৌঁছালেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশের লাউঞ্জে তাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়। অন্যদিকে, বিনা আমন্ত্রণে হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সশস্ত্র লোকজন নিয়ে হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছান দুই অতিথিও। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তারা।
কিন্তু ইমরান খান পদ ছাড়ার পর কী হবে, সে বিষয়ে কোনো কিছু তখনও জানা যায়নি। তার ঘণ্টাখানেক আগে ইমরান খান বৈঠকে উপস্থিত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে কারণে অনামন্ত্রিত এই অতিথিদের হঠাৎ আগমন পাক প্রধানমন্ত্রীর জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত।
ইমরান খান ইসলামাবাদ ছাড়ার জন্য হেলিকপ্টারের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু এই হেলিকপ্টারের যাত্রীদের সম্পর্কে তার অনুমান ও প্রত্যাশা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়।
সূত্রগুলো বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আশা করেছিলেন, তার নবনিযুক্ত কর্মকর্তারা এই হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আসবেন এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংসদ ভবনে যে শোরগোল শুরু হয়েছে, তা হয়তো কমে যাবে।
এটি ঘটতে পারতো। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে বরখাস্ত এবং নতুন নিয়োগের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে আইনি বিজ্ঞপ্তি জারি করার নিয়ম আছে তা করা হয়নি। এভাবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ‘বিপ্লবী’ এক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনীর প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া যদি সম্পন্ন করাও হতো, তাহলে সেটি বাতিল ঘোষণা করার আয়োজনও আগেভাগেই করে রেখেছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শনিবার মধ্যরাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যখন এসব নাটক চলছিল, তখন আকস্মিকভাবেই ইসলামাবাদ হাই কোর্টের দরজা খুলে যায় এবং প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহর কর্মীরা হাইকোর্টে পৌঁছান।
পরে জানানো হয়, হাইকোর্টে একটি জরুরি আবেদনের শুনানি শুরু হবে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আইনজীবী আদনান ইকবাল প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সেনাপ্রধানকে অপসারণের ‘সম্ভাব্য’ প্রজ্ঞাপন জারির চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন।
জরুরি আবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন এবং সেনাপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। যে কারণে জনস্বার্থ বিবেচনায় ইমরান খানের এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে আদালতের আদেশ দেওয়া উচিত।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মাঝরাতে আদালতে পিটিশন দায়ের করা হলেও সেখানে সেনাপ্রধানের অপসারণের বিজ্ঞপ্তি নম্বরের জায়গায় ফাঁকা রাখা হয়েছিল। এর কারণ ছিল, প্রধানমন্ত্রী তখনও প্রজ্ঞাপন জারি করেননি এবং যে কারণে আর শুনানিই অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিকে, রোববার পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বিবিসি উর্দুর প্রকাশিত এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তার বাসভবনে সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকের খবরকে ‘একেবারে ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচার’ বলে অভিহিত করেছে আইএসপিআর।