চলতি ২০২২ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ সাগাইংয়ে শতাধিক গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন জান্তা। দেশটিতে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের অংশ হিসেবে এসব গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ।
সম্প্রতি রয়টার্সের হাতে স্যাটেলাইটে তোলা কিছু ছবি এসেছে। ছবিগুলো তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ ইমেজিং কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবস ও দেশটির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার কৃত্রিম উপগ্রহ। সেই সব ছবিতেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া আগুনে জ্বলে যাওয়া, ভস্মীভূত হওয়া গ্রামগুলোর কিছু ছবি এসেছে।
পরে এই ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে রয়টার্স জানতে পেরেছে যে, সেগুলো মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ সাগাইংয়ের বিভিন্ন গ্রামের ছবি। ভস্মীভূত কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা রয়টার্সের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, জান্তাবিরোধী কয়েকটি সশস্ত্রগোষ্ঠী এসব গ্রামকে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে— এই সন্দেহে গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে সরকারি বাহিনী।
তবে পুড়ে যাওয়া বেশ কিছু গ্রামে জান্তাবিরোধী কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা ছিল বলে রয়টার্সের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
এদিকে, এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ এ সম্পর্কে রয়টার্সকে বলেন, ‘এটা আসলে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের সন্ত্রাসের চিত্র এবং মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের জন্য সতর্কবার্তা। এই পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে দেশটির সাধারণ জনগণকে জান্তা বোঝাতে চাইছে যে, সরকারবিরোধীদের আশ্রয় দিলে এই পরিণতি নেমে আসবে।’
অ্যান্ড্রুজ জানান, সামরিক বাহিনীর তৎপরতা জানতে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তিনি। সেসব সূত্র জানিয়েছে, সরকারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে গত বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সাগাইংয়ে অভিযান জোরদার করেছে সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারের একাধিক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ও সাগাইং প্রদেশের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, গত প্রায় চারমাসে শতাধিক গ্রামের হাজার হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সেনা সদস্যরা। স্থলবাহিনীর সদস্যরা একদিকে গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে, অন্যদিকে বিমান বাহিনীর সদস্যরা জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে করছে গোলাবর্ষণ।
বিবিসি বার্মিজ জানিয়েছে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো গ্রামে অগ্নিসংযোগ করেছে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
অগ্নিসংযোগ ও গোলাবর্ষণে ইতোমধ্যে সাগাইং প্রদেশে বহু বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছেন, এবং অন্তত ৫২ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের একাধিক মুখপাত্র বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ করছে সরকারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।
কিন্তু মঙ্গলবার স্যাটেলাইটে এসব গ্রামের ছবি প্রকাশের পর এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সরকারি মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স; তবে কেউই মন্তব্য করতে সম্মত হননি।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। বন্দি করা হয় অং সান সুচি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। সেনা প্রধান মিন অং হ্লেইং এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পরপরই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী জনগণ। রাজধানী নেইপিদো, বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়সহ ছোট বড় বিভিন্ন শহরে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়।
বিক্ষোভ দমনে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম দিকে লাঠিচার্য, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, জল কামান ব্যবহার করলেও পরে জান্তার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে বাহিনীর সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ইতোমধ্যে দেশটিতে প্রায় ১৫ শ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
অহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন জান্তাকে হটানো সম্ভব নয়- বুঝতে পেরে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের অনেকেই গোপনে যোগ দিচ্ছেন সামরিক বাহিনীর বিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, সাগাইং অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা থাকলেও পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)- এই দুই গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি।
এসকেএইচ//