• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯, ০৬:১২ পিএম

‘বীরভূমি’ বঙ্গের অহংকার শ্রীহট্টের (সিলেট) পুণ্যভূমি

‘বীরভূমি’ বঙ্গের অহংকার শ্রীহট্টের (সিলেট) পুণ্যভূমি
প্রাচীন বিশ্ব মানচিত্রে নন্দরাজ্য (গঙ্গারিড)- ছবি: ফাইল ছবি

 

গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় রচিত একাধিক গ্রন্থে প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে গঙ্গারিডাই  নামক একটি জনগোষ্ঠী ও একটি দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাসের শুদ্ধ তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে একথা প্রতিষ্ঠিত যে দ্বিগবিজয়ী মহাবীর আলেকজেন্ডার এই সারা বিশ্বের যে একখন্ড ভূমি করতলে নিতে পারেননি, সেটি এই গঙ্গারিডাই! গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারিড ভারতীয় ‘গঙ্গাহূদ’ শব্দের গ্রিক রূপ যার অর্থ ‘যে ভূমির (অঞ্চলের/ভূমির/দেশের) বক্ষে/বুকে গঙ্গা প্রবাহিত’।

ইতিহাসের প্রবাহ অনুসরণে এই অঞ্চলের যে সীমারেখা অনুমেয় তা প্রাচীন অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ এই তিনটি রাজ্যকে নির্দেশ করে। সাম্প্রতিক বিশ্বে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত এই অঞ্চলের প্রাচীন বঙ্গ ভূমের যে অংশ ‘বাংলা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তার সবচেয়ে বিস্তৃত অংশটিই আজকের বাংলাদেশ। সে অর্থে একথা বলাই যায় যে মহাবীর আলেকজেন্ডারের কাছেও যে ভূখন্ড অজেয় ছিলো তা আজকের 'বঙ্গ' বা 'বাংলা'। যার মূল ভূখন্ড জুড়ে বীর জাতিসত্ত্বর গর্ভধারিনী আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আর আমরা 'বঙ্গবাসী', গর্বিত বাঙালি। তবে ইতিহাসের পাতায় 'বঙ্গ' নামের স্বীকৃত উপস্থিতির আগেই একটি স্বকীয় রাষ্ট্র হিসেবে যে অঞ্চলের অস্তিত্ব এ বঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে সেটি হলো প্রাচীন 'শ্রীহট্ট' বা আজকের সিলেট অঞ্চল। অর্থাৎ বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাণ্ডারি হিসেবে সগৌরবে প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে আসছে পুণ্যভূমি সিলেট।
 
 শুধু যে আমাদের জানা আজকের সুখ্যাত মুসলিম অলি, আউলিয়া ও সাধু-দরবেশদের ভূমি হিসেবে তাই নয়; পৌরাণিক মতে পৃথিবীর প্রাচীনতম জৈনধর্ম এবং হিন্দুধর্মেরও তীর্থস্থান হিসেবে সুপ্রাচীন কাল হতেই সিলেট অঞ্চলের সুখ্যাতি রয়েছে। এমন কি হিন্দুপুরাণ মতে মহাবীর অর্জুনের আগমনের কথাও উল্লেখিত আছে এখানে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্যতম মহাবীর, মহাভারতের যুদ্ধে নিহত রাজা ভগদত্তের আমলে গাঙ্গেয় রাজ্যের উপ-রাজধানীটি যে 'লাউড়' পর্বতাঞ্চলে বিদ্যমান ছিলো বলে জানা যায় সেটি আজকের সিলেট অঞ্চলের অন্তর্গত (লাউয়াছড়া বনাঞ্চল তারই একটি অংশ)। আবার ধারনা করা হয় গঙ্গার প্রধান পাঁচটি শাখা মুখের তিনটি (মণিপুরী অঞ্চল সংলগ্ন প্রবাহমান ভাগিরথী যার মধ্যে অন্যতম ) যে অঞ্চল সংলগ্ন তার মূলে সৃষ্টি হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপ। আর বর্তমানের ভৌগোলিক জ্ঞান আমাদের জানান দেয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপটিও এ অঞ্চলে, যার নাম বাংলাদেশ!

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বঙ্গ অঞ্চলের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা ভগদত্ত।  যার রাজ্যের উপ-রাজধানী হিসেবে সিলেটের লাউড় পর্বতাঞ্চলের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই বঙ্গ অঞ্চল সেকালে প্রসিদ্ধ ছিল তার শক্তিশালী হস্তিবাহিনীর জন্য, সে কথা কুরুক্ষেত্রের ইতিহাসে সুস্পষ্ট বর্ণিত আছে।  শুধু কুরুক্ষেত্র নয় তদপরবর্তী ইতিহাস অনুসারে, দ্বিগবিজয়ী মহাবীর আলেকজেন্ডার বিশ্বের যে একখন্ড মাটিতে নিজের বিজয় কেতন উড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটি তার জন্য দুঃসাধ্য করে তুলেছিল এই সুপ্রশিক্ষিত রণহস্তি বাহিনী। আর সেই একখন্ড ভূমি ইতিহাস অনুসারে জন্মলগ্ন হতে ‘বীরভূমি’ হিসেবে বঙ্গের ঐতিহ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ধারনা মতে, লাউড় পর্বতাঞ্চল সংলগ্ন পাহাড়ি বনাঞ্চলের বুনো হাতির পালকেই রণকৌশলে প্রশিক্ষিত করে গড়ে উঠেছিলো বঙ্গের এই অজেয় গজবাহিনী। যেহেতু শ্রী অর্জুন ও রাজা ভগদত্তের পূর্বশ্বরীগন মূল ভারতীয় ভূ-খন্ড হতে এসেছেন যুদ্ধে যোগদিতে, তাদের সাথে করে আসেনি এই হাতিরপাল। কারণ সে সময় শুধুমাত্র জলপথই ছিলো ভরসা। সে পথে হাতি টানতে হলে ভারত হতে লঙ্কা পর্যন্ত যেমন, তেমন আরো একটি পাথুরে সেতুর অস্তিত্ব এতদিনে পাওয়া যেত।

আলেকজান্ডার ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস (৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-১৬ খ্রিস্টাব্দ) সিন্ধু পরবর্তী দেশ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, গঙ্গা পেরিয়ে যে অঞ্চল সেখানে ‘প্রাসিয়ই’ ও ‘গঙ্গারিডাই’-দের আধিপত্য ছিল। সম্প্রতি বর্তমান বিশের  মানচিত্রে গঙ্গারিড অঞ্চলের যে সীমা অংকিত হয়েছে তাতে বাংলা তথা বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তি সুস্পষ্ট। বর্ণনা মতে, সে সময় রাজা মহানন্দের উত্তরসূরি নন্দ রাজার নেতৃত্বে যে সেনাদল আলেকজেন্ডার বাহিনীর মুখোমুখি হবার প্রতীক্ষায় ছিলো তাতে ছিলো প্রায় ২লক্ষ পদাতিক সৈন্য, ৬০ মতান্তরে ৮০ হাজার সমর সজ্জিত অশ্বারোহী এবং ৮০০০ রণসজ্জিত যুদ্ধরথ। যার নেতৃত্বে ছিলো প্রায় ৬০০০ যুদ্ধকৌশলে সুপ্রশিক্ষিত রণহস্তির পাল (সর্বনিম্ন অনুমানে)। আজো সিলেটের বনাঞ্চলে রাজষিক চালে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় সেই গজরাজদের উত্তরসূরীদের।

প্রাচীন বঙ্গ হতে আজকের বাংলাদেশ, উত্থান হতে অদ্যবধি বাংলার ইতিহাসের পাতায় সেই রাজষিক গজরাজদের মতই সমহীমায় ভাস্বর গঙ্গারিডাই-এর ইতিহাস, যা জন্মলগ্ন হতে 'বাংলা' কে বীরভূমি এবং 'বাঙালি' কে বীরের জাত হিসেবে পরিচিতি করে। সেই সাথে তুলে ধরে বাংলার গৌরব এই শ্রীহট্ট তথা শুদ্ধপ্রাণ মহামনীষী, মহাঋষি ও মহামুণিদের চরণ-স্পর্শে ধন্য, পুণ্যভূমি সিলেটের ঐতিহ্য গাঁথা।

এমএইচ

অনুসন্ধানি ফিচার, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্পৃক্ত