সাক্ষাৎকার
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
জাগরণকে দেওয়া সাক্ষাতকারে নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেছেন, মিশ্র অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আশা-নিরাশার দোলাচল নিয়ে আমরা আসন্ন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি অপরিণত রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দেশ। কাজেই শতভাগ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক হবে। জাগরণের পক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ জাকির হোসেন দিদার।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর, বগুড়ায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৭০ সালের ৩ আগস্ট। নিয়মিত অধ্যাপক হিসেবে সেখান থেকেই অবসর নেন ১ জুলাই ২০১৪ সালে। সুপারনিউমারি অধ্যাপক হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যুক্ত আছেন। এর বাইরে বিইউপির বঙ্গবন্ধু চেয়ারের অধ্যাপক হিসেবে আসন অলঙ্কৃত করে আছেন।
জাগরণ : বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কি সন্তোষজনক? গত ১০ বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো উন্নতি হয়েছে কি? বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করবেন?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : গত ১০ বছরে শিক্ষার গাণিতিক ব্যাপ্তি ঘটেছে। পাসের হার বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষিতের হার কমেছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের শিক্ষা সম্পর্কে মৌলিক কোনো ধারণা নেই। সত্যি বলতে কি, আমি দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ শঙ্কিত। কারণ শিক্ষা ধসে গেলে বৈষয়িক প্রবৃদ্ধি ও উন্নতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমার মনে হয় না শিক্ষা-সম্পৃক্ত নীতিনির্ধারকবৃন্দ আমাদের শিক্ষার গলদ ও সংকট সম্পর্কে সচেতন ও অবহিত। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ও শিক্ষার উপাদানে আমূল সংস্কার না করলে সামনে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। লক্ষণীয়, পাসের ক্রমবর্ধমান হার শিক্ষার গুণগত মান নির্ধারণের সূচক নয়। তারপরও কথা আছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃত্রিমভাবে ভালো ফলের বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিকভাবে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান হিসেবে সরকারের স্বীকৃতির ফলে শিক্ষাব্যবস্থা এক দারুণ সংকটে পড়েছে। কিন্তু স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি নিয়েও কি কওমির শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারবে? কওমি মাদ্রাসার যে পাঠ্যক্রম, তা বাংলাদেশের চাকরির বাজারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। সুতরাং সিদ্ধান্তটি এক চরম অবিমিষ্যকারিতা। এতে করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে।
জাগরণ : ধর্মীয় শক্তির উত্থানের ফলে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে হয়? একটু ব্যাখ্যা করেন।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : পঁচাত্তরের পর থেকেই রাজনীতিতে ধর্মীয় শক্তির উত্থান ও বিকাশ। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় রাজনীতির কোনো অবকাশ নেই। অবশ্য সংবিধানটি স্ববিরোধী। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে রাষ্ট্রধর্মেরও বিধান আছে। সুতরাং আমাদের মূল গলদ সংবিধানেই। দ্বিতীয় গলদ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি আওয়ামী লীগের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি রাজনৈতিক বিবেচনায় আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে থেকে ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে সখ্য তৈরি করে যাচ্ছে। এমনকি এমন শক্তিকে তোষণ করবার জন্য পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণও করা হচ্ছে। ইতিহাস বলে, এমন আপসকামী ও অদূরদর্শী নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ফল কখনও শুভ হয় না। মিসরের আনোয়ার সাদাত মুসলিম ব্রাদারহুডকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন রাজনীতির স্বার্থে; কিন্তু সেই মুসলিম ব্রাদারহুডই তাকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কোনো দিনও আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না এবং তাদের ওরা মিত্রও নয়। অবশ্য এদের ভোটে আওয়ামী লীগ লাভবান হোক, তাও আমাদের প্রত্যাশা নয়।
জাগরণ : আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি বা ধারণা কি?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আশা-নিরাশা দুটোই আছে। আশার জায়গাটি হলো, একটি গ্রহণযোগ্য মানের নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে নিরাশার কারণ হলো, নির্বাচন নিয়ে নিকটঅতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অন্যদিকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মানের নির্বাচনের দৃষ্টান্তও আমরা তৈরি করেছি। সুতরাং মিশ্র অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আশা-নিরাশার দোলাচল নিয়ে আমরা আসন্ন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি অপরিণত রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দেশ। কাজেই শতভাগ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক হবে। কিছু ব্যত্যয়-বিচ্যুতি অনিবার্য। তা সত্ত্বেও আমাদের আশার নামটি হলো, একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য মানের নির্বাচন।
জাগরণ : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও বিপক্ষশক্তি এই যে বিভাজন, এ থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব? একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : এমন একটি অনাকাক্সিক্ষত বিভাজন বাংলাদেশে একটি বাস্তব সত্য। কারণ পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির পুনর্বাসন হয়েছে রাজনীতিতে। প্রধানত বিভাজনের সূচনা সেই থেকে। জে . জিয়া-এরশাদ ও বেগম জিয়া মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের পোষকতা না দিলে বা পুনর্বাসন না করলে, এ বিভাজন কখনই সৃষ্টি হতো না। বর্তমানে রাজনীতির যে চালচিত্র, তাতে এ বিভাজনের নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐকান্তিক থাকতে হবে, তা হলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষ ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাবে, অথবা নিশ্চিহ্ন হতে পারে।
জাগরণ : বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য ও সাহসী পদক্ষেপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার- এ বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বর্তমান সরকারের একটি উজ্জ্বল সাফল্য, তবে এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক দৃঢ়তা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সরকার ছাড়া এ বিচার কোনোদিনই হতো না। এজন্য এ সরকারের ভূমিকা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য।
জাগরণ : বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? বুদ্ধিজীবীদের বর্তমান ভূমিকা কি যথাযথ বা সঠিক বলে আপনি মনে করেন?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের বর্তমানে হাল-হকিকত সন্তোষজনক নয়। বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সরকার ও দলনিরপেক্ষ থেকে দেশ ও জনগণের জন্য হওয়া উচিত। ভালো কাজে সরকারের প্রশংসাও করতে হবে, একই সঙ্গে মন্দ ও বিতর্কিত কাজের জন্য সমালোচনাও করতে হবে। এভাবে সরকারের ত্রুটি ও ভ্রান্তি নির্দেশ করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী দলভিত্তিক বিভাজনের শিকার। ফলে তারা কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকারের স্তুতি বা অন্ধ বিরোধিতা কোনোটিই তাদের কাছ থেকে কাম্য নয়।
জাগরণ : বাংলাদেশে পরিবার ব্যবস্থায় অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। অসামাজিক কার্যকলাপ অনেক বেড়েছে। সন্তানদের প্রতি বাবা-মার দায়িত্বশীলতা কমেছে। সম্পর্কও শিথিল হয়ে পড়ছে। এ সমস্যাকে কীভাবে মোকাবেলা সম্ভব?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বাংলাদেশে পরিবার ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। এর একটা সামগ্রিক কারণ হলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বর্তমান বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত সমাজ বিত্ত-বিষয় ভাবনায় তাড়িত; কিন্তু কারো-বা সংস্কৃতি বাসনা উধাও। ফলে পরিবারের যে কাঠামো থাকার কথা, তা ক্রমেই ভেঙে যাচ্ছে। ভেঙে যাবার পথে এমন সব পরিবার ক্রমেই দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক অপরাধ যেমন বাড়ছে, তেমনি কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ব্যাপারটি বড় রকমের একটি অশনি সংকেত। পারিবারিক সদস্যবৃন্দের মধ্যে সম্পর্কের যে সেতুবন্ধ থাকার কথা, তার গ্রন্থিগুলো ক্রমেই যেন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বাবা-মা ও সন্তান-সন্ততি যেন ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা হয়ে উঠছে। ফলে ঐশীর মতো কিশোরীরা বাবা-মার হত্যাকারীতে পরিণত হচ্ছে। উপরন্তু কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম আরও অনেক ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকছে। মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের একটি পঙক্তি, ‘মানুষ না ভেবে কাজ করে যাই শুধু ভয়ঙ্করভাবে অনায়াসে’।
জাগরণ : একটি মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজের স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি একটি স্বপ্নের ঠিকানা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র।” উপরন্তু তার আরেকটি স্বপ্নবহুল উচ্চারিত, ‘সোনার বাংলা’। অর্থাৎ আমাদের পথের ঠিকানায় আছে দুটি গন্তব্য- আদর্শ রাষ্ট্র ও সোনার বাংলা। এ দুটো স্বপ্ন রূপায়িত হলেই বাংলাদেশ অবশ্যই একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। আজ এতদিন পর দেখি, আমাদের স্বপ্ন অপরিবর্তিতই আছে। কিন্তু স্বপ্ন রূপায়ণের প্রয়াস প্রশ্নবিদ্ধ এবং নানাভাবে সীমিত। আমার মনে হয়, মানবিক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে নেতৃত্বের অবদান সবচেয়ে বেশি। নেতৃত্বের গণসম্পৃক্ততা এবং গণআদর্শভিত্তিক দূরদর্শী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই এমন একটি রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে, এমন দর্শন ও দূরদর্শিতার অভাব। এর ফলে নজর-কাড়া প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন এখনও সুদূরপরাহত। কারণ আমাদের সমাজে ধনবৈষম্য বিরাজমান ও ক্রমবর্ধমান, যা নিরসনে সরকারের আদর্শ ও দর্শনভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ নেই। একটি বৈষম্যপূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে মানবিক রাষ্ট্রের কাঠামো নির্মাণ অসম্ভব ও অযৌক্তিক।
জিএম/এস_খান