• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২১, ০৮:১২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৭, ২০২১, ০৯:১০ এএম

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দেশ স্বাধীন করতে হবে: যতীন সরকার

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দেশ স্বাধীন করতে হবে: যতীন সরকার

প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার। আজীবন ময়মনসিংহে থেকেছেন তিনি এবং প্রধানত নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর রচিত বইগুলো গভীর মননশীলতা ও মুক্তচিন্তার স্বাক্ষর বহন করে। ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনি ময়মনসিংহ শহরের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। অসাধারণ বাগ্মীতার জন্য তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ২০০৮ সালে তিনি গবেষণা ও প্রবন্ধের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১০ সালে তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ জাগরণকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেন। কথা বলেন সুব্রত চন্দ


জাগরণ : ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন? আপনার কাছে জানতে চাই।

যতীন সরকার : ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন, তা আমি আলাদা করে আর কী বলব? আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম যখন দেখি ১৯৫৩ সালে, তখন তিনি বঙ্গবন্ধু হননি। তিনি তখন শেখ মুজিবুর রহমান, ২৭ বছরের মতো বয়স। আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। সে সময় নেত্রকোনায় মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ময়মনসিংহের হাসিম উদ্দিন এসেছিলেন। ওনাদের বক্তৃতা শুনলাম। সর্বশেষ বক্তৃতা দিলেন একজন, নাম শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান। একজন ইয়াংম্যান। এ রকম চমৎকার বক্তৃতা এর আগে আমি কোনো দিন শুনিনি। প্রত্যেকটা মানুষ অন্য সব বক্তৃতা রেখে শেখ মুজিবুরের কথাই বলল শুধু। এত বলিষ্ঠ কণ্ঠ, এত চমৎকার বক্তব্য সেই পাকিস্তান আমলেই। এরপরে আর আমি বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিন দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কোনো দিন কথাবার্তা হয়নি। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনেছি।

জাগরণ : ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর কারাবাস—এই সময়টায় বঙ্গবন্ধুর বিকাশ সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।

যতীন সরকার : বঙ্গবন্ধুর বিকাশ আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। ১৯৬২-৬৫ এই সময়গুলো আমি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে আমি জানি। ১৯৬১-৬২তে কমিউনিস্ট পার্টির খোকা ভাই ও মণি সিংহের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। সেই সময়ই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, আর কিছু হবে না, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তখন খোকা ভাই আর মণি সিংহ বলেছিলেন, স্বাধীনতা আমরাও চাই এবং ১৯৫৬ সালেই আমাদের এই বিষয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং চারটি গণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করা উচিত। যেদিন স্বাধীনতার ডাক আপনারা দেবেন, আমরা থাকব। এরপর তো আমরা জানি, ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ইত্যাদি যে ঘটনাগুলো ঘটল, এগুলোর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেছে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং এর আগের সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ মোটেই এক না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আস্তে আস্তে যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল, সেটাই স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতাকে কমিউনিস্ট পার্টিও সমর্থন করে যুদ্ধে যুক্ত হলো। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে এলেন, তখন সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা বঙ্গবন্ধু করলেন, তা হলো আমাদের চার মূলনীতির ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন। এটার চেয়ে বড় কথা হলো, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। এই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হলো।

আজকের দিনে যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের সেই চার মূলনীতি যথার্থ অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যথার্থ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু যেভাবে শোষিতের গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, সমবায়ের কথা বলেছিলেন, সেসব বিষয়কে সামনে নিয়ে এসে যথার্থ অর্থেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মূলনীতি ধরে অগ্রসর হতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর যথার্থ উত্তরাধিকার বাহিত হবে বলে আমি মনে করি।

জাগরণ : বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

যতীন সরকার : বঙ্গবন্ধু যা করতে চেয়েছিলেন, তা তিনি স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরে অনেকখানি করেছেন এবং অনেকখানি অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভূত বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে। বঙ্গবন্ধু যা করেছিলেন, সেই সংবিধানটাকেই কেটেকুটে ফেলে দেওয়া হলো। জঙ্গিতন্ত্র, পাকিস্তানি বাগধারা এখানে ফিরে এলো। এখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা ক্ষমতায় বসার পরও পাকিস্তানের বাগধারার লোকগুলো যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিশালী হয়ে আছে। এখনো জামায়াতে ইসলামী আছে। এই দলটিকে এখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের মধ্যে ছিল, কোনো ধরনের ধর্মতন্ত্রের মৌলবাদ যাতে এ দেশে চেপে বসতে না পারে। কিন্তু ধর্মতন্ত্রের মৌলবাদ নানাভাবেই আমাদের ওপর চেপে বসেছে এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যেও একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বলা হয়েছে। এই বিশেষ ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম আছে, আবার চার মূলনীতির ধর্মনিরপেক্ষতাও আছে। এটা একটা গোঁজামিলের মতো অবস্থা চলছে। এই অবস্থাকে পরিবর্তন করতে হলে একটা বড় রকমের সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সর্বশেষ সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। সেই রকম একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া বাংলাদেশের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে না। পাকিস্তানের ভূতকে আমরা দূর করতে পারব না।

জাগরণ: আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দল। বঙ্গবন্ধুর সময়ের কিংবা এর আগের আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখনকার আওয়ামী লীগকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

যতীন সরকার: বঙ্গবন্ধুর যে আওয়ামী লীগ, সেই আওয়ামী লীগকে বর্তমান আওয়ামী লীগ রক্ষা করতে পারছে না। কারণ পাকিস্তানের ভূত আমাদের মধ্যে ঢুকে গেছে। এই অবস্থাকে পরিবর্তন না করতে পারলে বর্তমান আওয়ামী লীগের হাতেও সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমি বারবারই এই কথা বলি, এটা কেবল আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে সার্বিকভাবে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপর। যদি দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের ভূতের বিরুদ্ধে সার্বিক একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তাহলেই সেটা সম্ভব। আর না হলে আওয়ামী লীগের হাত দিয়ে শেখ মুজিবের যে আওয়ামী লীগ, সেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।