• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৫:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১, ০৭:০১ পিএম

রসুলপুর...

রসুলপুর...

চারটা বেজে গেছে, একটু পরেই মধুপুরের গাড়ি চলে আসবে। যতই শামীমার দিকে তাকাচ্ছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি আমি। ওর চোখে-মুখে কী যেন এক সম্মোহন লেগে আছে। অনুশোচনা হচ্ছে ভীষণ, জীবনের শুরুতেই হয়তো বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই মধুপুরের শেষ বাসটা এসে নেদু মিয়ার বাজারে থামল, আর মিনিট পাঁচ পরেই শামীমাকে নিয়ে চলে যাবে বাসটা... 
 
বেশ কিছুদিন ধরেই মনটা ভীষণ খারাপ। কোনো কারণ ছাড়াই মাঝেমধ্যেই এমনটা হয় আমার। মাথাটা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগে কলমটাও যেন স্ট্রাইক করেছে, কিছুই লিখতে পারছি না। কাগজের মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকি, কথা কই মনের অক্ষরগুলোর সঙ্গে; কিন্তু কিছুতেই কিছু বের হয় না। চা খাই, বিড়ি টানি, চুল ছিঁড়ি, নখ খুঁটি কিন্তু তারও একটা সীমা থাকে। কেমন একটা একঘেয়েমি পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে আমার চারপাশটা। আর বিন্দুমাত্র দেরি না করেই মোটরসাইকেল আর কাঁধের ব্যাগটায় ক্যামেরাটা নিয়ে ছুটলাম জঙ্গলের দিকে। আমার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ সন্তোষপুর, জঙ্গল তারপর রসুলপুর। জঙ্গলের একটা বিশেষ ঘ্রাণ আছে, হরেক রকমের পাতা আর ফুলের সংমিশ্রণে সৃষ্ট ঘ্রাণ। অনেকটা ভেজা ভেজা...
সন্তোষপুর জঙ্গল পাড়ি দিয়েই রসুলপুরের পথ, নানান ধরনের পাখির সুর আর কাকলিতে মুখরিত চারপাশ। কোনো কোনো গাছের উঁচু ডাল থেকে বানরগুলো চেঁচিয়ে মরছে। বুকের মধ্যে বহুদিন পুষে রাখা একটা নাম ধরে চিৎকার করে বেশ কয়েকবার ডাক দিলাম। নামগুলো চারপাশে একবার চক্কর দিয়েই ডাল আর পাতার আবডাল বেয়ে বেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বেশ কিছু প্রজাপতি, ভেষজ গাছ আর বেশ কয়েক প্রজাতির বুনো ফুলের ছবি পাওয়া গেল। এই রসুলপুর ফরেস্ট বিটের শেষ প্রান্তে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। সেখানকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। স্কুলের পাশ ঘেঁষে একটা সরু রাস্তা নেদু মিয়ার বাজারের দিকে উঠে গেছে। বাজারে নেদু মিয়ার একটি জনপ্রিয় হোটেল আছে। 
সেই হোটেলে মহিষের দুধের রসগোল্লা আর পরোটার স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। জঙ্গলে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে রসগোল্লা আর পরোটা খেয়ে আসি। যখন স্কুলটা ক্রস করব তখন পুরো মধ্য দুপুর, স্কুলের ক্লাস চলছে। একটা আধবয়সী কুকুর বারান্দাতে চুপটি মেরে শুয়ে আছে পাশেই একটা দোলনায় পা ঝুলিয়ে এক শিশু দোল খাচ্ছিল। ছেলেটাকে দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। অবশেষে মনটা আর মানল না মোটরসাইকেল থামিয়ে ছেলেটার কাছে এলাম, বললাম তোমার একটা ছবি তুলি এদিকে তাকাও দেখি। ছেলেটার চোখ দুটি ভীষণ মায়াবী। কোথায় যেন দেখেছি। এত আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার সেই বন্ধুটা নয় কি?
তোমার নাম কী বাবু? 
গাম্বু!
তুমি স্কুলে যাও না?
 না, সেকি কেন?
ভালা লাগে না!
তাহলে কী করতে তোমার ভালো লাগে? 
বড় হইতে! 
বড় হয়ে কী করতে চাও, আব্বার লাহান রিকশা চালামু, তোমার আব্বা বুঝি রিকশা চালায়?
না, আগে চালাই তো, আব্বার লাল রিকশা আছিলো, অহন নাই, মার অসুকের সময় বেইচ্চা দিছে আব্বায়, অহন আব্বায় মাডি কাডে, আমনে কেডা? কই থাহেন?
আমি, আমি একটা চোর, এখানে চুড়ি করতে এসেছি!
কারে?
তোমারে...!
 এ কথা শোনার পর দোলনা থেকে কোনোমতে নেমেই ছেলেটা দিল দৌড়, ওর ছোট ছোট পায়ের আঁচড়ে, পথের ওপর জমে থাকা লাল ধুলোগুলো এদিক-সেদিক উড়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিমেষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল ছেলেটা। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটা মেয়েলি ঢঙের আওয়াজ শুনতে পেলাম আনন্দ- এই আনন্দ...
পেছেন ঘুরে তাকিয়ে দেখি বোরকা পরা, মুখে নেকাব লাগানো। মাথায় ছাতা ফুটিয়ে একটি মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কে এই মেয়ে আমার নাম ধরে ডাকছে, কী জানি পরিচিত হবে হয়তো, এভাবে মুখ ঢাকা থাকলে কে কাকে চেনে, শুধু মুখে একটা শুকনো হাসি গুঁজে রাখলাম মেয়েটি সামনে আসা অব্দি। 

দুই.

আমায় চিনতে পেরেছ আনন্দ? 
হুম, ঠিক চিনতে পারছি না!
পরক্ষণেই মেয়েটা টান দিয়ে মুখের নেকাবটা খুলে ফেলল। 
আরে আমি শামীমা, শামীমা নাসরিন; আমরা আনন্দমোহনে একই ডিপার্টমেন্টে ছিলাম মনে পড়ছে জনাব এবার?
ও হে-হে তাই তো, কী আশ্চর্য ব্যাপার, তা কেমন আছ? 
আমি পুরোপুরি কিন্তু শামীমাকে চিনতে পারিনি এখনো। লেখাপড়া শেষে করেছি আজ প্রায় তিন বছর। পরীক্ষা বাদে বছরে দু-একবার ক্লাসে যাওয়া হতো, তখন উদিসার সঙ্গে একজনকে প্রায় সময় আসতে দেখতাম ক্যাম্পাসে। সে সময় ওর গায়ের রং কালো ছিল। এখন অনেকটা উজ্জ্বল শ্যামলা, বেশ সুন্দর লাগছে ওকে। তরতরে নাক বাঁ গালে ছোট একটা তিল। অনেকটাই বদলে গেছে মেয়েটা। হয়তো উদিসাও এত দিনে অনেকটা বদলে গেছে, হয়তো আরো সুন্দরী হয়েছে সে। চোখে বেশ টানটান করে কাজল টেনেছে শামীমা।
ভালো আছি, তুমি তো দেখি একদম সেই আগের মতোই আছ, সেই লম্বা চুল, পাঞ্জাবি, কাঁধে কবিয়াল ব্যাগ এখনো দেখছি ঝোলানো থাকে! 
হা হা হা, না আর বদলানো গেল না নিজেকে, তোমার কিন্তু কেশ চেঞ্জ এসেছে!
কেমন? 
আগে এই ছিপছিপে একটা মেয়ে ছিলে এখন তো দেখতে বেশ!
ও মা, তাই? হা হা হা! 
হাসলেও কিন্তু দারুণ লাগে!
শুনে আবারো হাসল শামীমা! 
তা তুমি এখানে? এই স্কুলে?
হে তিন মাস হলো এই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি, এর আগে একটা এনজিওতে ছিলাম এটা হয়ে গেছে তাই ওটা ছেড়ে চলে এলাম!
তোমার বাড়ি যেন কোথায়? 
মধুপুর!
তা তো বেশ দূরের পথ, প্রতিদিন মধুপুর থেকেই আসা-যাওয়া করা হয়?
হে, তা একটু দূরেই হয়ে যায় বটে, ভাবছি ট্রান্সফার নেব; বাদ দাও ওসব, এবার তোমার কথা বলো, কোথায় আছ? আর এখানে কী করো? উদিসা কানাডায় যাওয়ার পর সেই যে লাপাত্তা হলে, আফজালের কাছে শুনেছি তুমি কোন এক পত্রিকা অফিসে চাকরি নিয়েছ। এখনো কি সেখানেই আছ? 
নাহ, চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি: 
কেন? ভালো লাগেনি বুঝি? বেশ হেঁয়ালি চোখে আমার দিকে তাকাল শামীমা।
আমি কিছু না বলে ঠোঁটের ডগায় ছোট্ট একটা হাসি গুঁজে রাখলাম।
তা কোথায় যাচ্ছিলে?
এই তো নেদু মিয়ার বাজারে, তার দোকানের পরোটা আর রসগোল্লা খাব!
বাহ, তাহলে তো ভালোই হলো, আমি তো ও পথেই যাব। বিকেল চারটায় মধুপুরের বাস ধরব!
তাহলে তো হয়েই গেল, আপত্তি না থাকলে আমার বাইকেই উঠে পড়তে পারো!
বারে, আপত্তি থাকবে কেন?
পড়ন্ত বিকেল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে লাল মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা, চারপাশটা সবুজে ঘেরা, শামীমা আমার পেছনেই বসা। ও ওর ডান হাতটা আমার কাঠে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তা হওয়ার কারণে কিছুক্ষণ পরপর ব্রেক কষতে হয় বাইকের। আর ব্রেক করার সঙ্গে অনেকটা অতর্কিতভাবেই শামীমার বুক আমার পিঠের ওপর এসে লেগে যায় তার পরক্ষণেই কেমন যেন নড়েচড়ে বসে শামীমা। আমরা দুজনেই চুপচাপ, জঙ্গলের কেচকেচানি পোকারা অবিরাম চেঁচিয়েই যাচ্ছে, পেছনে উড়ে যাচ্ছে লাল ধুলাগুলো। 
তোমার বাড়ি কি আশপাশেই আনন্দ? এবার মৌনতা ভাঙল শামীমা। 
ও হে পাশের ইউনিয়ানে, বাদিহাটি!
খালাম্মা কেমন আছে?
আমি চুপ হয়ে গেলাম। শামীমা আবারো জানতে চাইল, কই বললে না খালাম্মা কেমন আছে?
মা নেই...
নেই মানে?
২ বছর আগে স্ট্রোকে মারা গেছে। 
তারপর যতক্ষণ অব্দি নেদু মিয়ার বাজারে না পৌঁছুলাম ততক্ষণ শামীমা আর একটিও কথা বলেনি। বাজারে পৌঁছানোর পরই নেদু মিয়ার দোকানে দুজন গিয়ে বসলাম, চারটা পরোটা আর দুটো রসগোল্লা দিতে বললাম। মায়ের খবর শোনার পর কেন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল শামীমা।
তারপর, বিয়ে করেছ শামীমা? 
হে!
কত দিন?
২ মাস ৩ দিন!
জামাই কী করে?
সরকারি কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ায়! লাভ ম্যারেজ? ঠিক সে রকম না, বিয়ের আগে পারিবারিকভাবেই দু-এক মাস আলাপের সুযোগ হয়েছিল আরকি!
বেশ ভালো! 
তুমি তো বিয়ে করোনি!
কী করে বুঝলে?
তুমি উদিসাকে ভালোবাসতে, ওকে তুমি নিজের মতো করে পেতে চেয়েছিলে। আসলে তোমাদের সম্পর্কটা এত মিষ্টি ছিল না, আমরা সবাই অবাক হয়ে ভাবতাম এত সুখ সইতে পারবে তো ওরা? কখনো কল্পনাই করতে পারিনি উদিসা তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আসলে ও মেয়েটাই এমন, কোনো ব্যাপারেই ওর স্থিরতা নেই, অস্থির একটা মেয়ে। আর তুমিও... 
আমি কী?
একজন উদিসাকে ভালোবেসেই জীবনপ্রাণ উজাড় করে দিতে হবে। আরো কেউ যে তোমাকে পছন্দ করতে পারে তাদের দিকে তোমার ফিরে তাকানোর সময় কোনো দিন হয়নি।
বাবা, আমাকে আবার কে পছন্দ করত তুমি নয়তো?
লজ্জায় কেমন টইটম্বুর হয়ে গেল শামীমা। আমি শামীমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম, মুহূর্তের জন্য হলেও ভাবলাম, আমার মনে হয় শামীমাকাইে ভালোবাসাটা উচিত ছিল। এমন একটা কেয়ারিং মেয়ে এই নিঃসঙ্গ জীবনে খুব প্রয়োজন ছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই শামীমা বলল;
তারপর লেখালেখি কেমন চলছে তোমার? অনেক দিন হলো তোমার কোনো লেখাই পড়া হয়। কলেজে থাকতে লিটলম্যাগে প্রায় ছাপা হতো তোমার লেখা, শেষ গল্পটা পড়েছিলাম বৃষ্টিকথা!
বই বেরিয়েছে?
হা হা হা...হাসতে হাসতে মুখটা ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলাম। 
লিখছি, লিখতে হয়। লেখার জন্যই চাকরিটা ছেড়ে দেওয়া। নারে ভাই অত পয়সা আমার কোথায়? তা ছাড়া প্রকাশক দেরি বা ঠেকা কিসের যে আমার বই ছাপাবে। আমার মতো ফুটপাতের লেখকদের তুলে আনতে তাদের কী ঠেকা পড়েছে? 
বারে, তাই বলে এত দিনে একটা বই থাকবে না তোমার এ কেমন কথা? 
হুম, টাকা কোথায় পাব?
কেন, আমি দেব টাকা। কত টাকা লাগবে বই করলে? 
এবার শামীমার কথায় অনেকটাই বিস্মিত হলাম আমি, মেয়েটির সঙ্গে যতই থাকছি ততই ভালো লাগছে আমার, ভালো থাকছি! ইউনিভার্সিটিতে বেশির ভাগ সময় কাটত আমার উদিসার সঙ্গে। মাঝে মধ্যে ওকে দেখতাম, তখন হয়তো একটু আধটু ফরমালিটিস দেখানোর জন্য মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হতো আরকি। শামীমাকে আমার কোনো লেখা তাকে দিয়েছি কি না, তা-ও মনে পড়ে না। 
কী হলো, কী ভাবছ, কিছু বললে না, কত টাকা লাগবে?
একটু রসিকতা করে বললাম, নতুন চাকরি তোমার এত টাকা একসঙ্গে কোথায় পাবে? জামাইয়ের পকেট মারবে নাকি?
এই যে মিস্টার, ভুলে যান কেন আমি এর আগেও আরেকটা চাকরি করতাম। বাড়িতে আমি টাকা কোনো কালেই পাঠাতাম না; কিছু টাকা জমানো আছে আমার, সে টাকা আমার। আমি সেখান থেকেই তোমাকে টাকাটা দিতে চাই তোমার বইয়ের জন্য!
দূর, শামীমা তুমিও? রসিকতাও বুঝো না, এটা কি হয় নাকি? 
জানি তো তুমি নেবে না আমার টাকা, আমি তো আর উদিসা না!
শোন শামীমা, উদিসা হলেও আমি তার কাছ থেকে টাকাটা নিতাম না!
উদিসা ফোন করে?
না!
কোনো যোগাযোগ নেই?
কিছুদিন ছিল, তার স্বামী নাকি বিষয়টা জেনে বেশ ঝামেলা করেছে, তাই সে-ও আর ইচ্ছে করে কোনো যোগাযোগ রাখেনি, আমিও না! 
চারটা বেজে গেছে, একটু পরেই মধুপুরের গাড়ি চলে আসবে। যতই শামীমার দিকে তাকাচ্ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি আমি। ওর চোখে-মুখে কী যেন এক অবাক সম্মোহন লেগে আছে। অনুশোচনা হচ্ছে ভীষণ, জীবনের শুরুতেই হয়তো বড় এ কটা ভুল হয়ে গেছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই মধুপুরের শেষ বাসটা এসে নেদু মিয়ার বাজারে থামল, মিনিট পাঁচ পড়েই শামীমাকে নিয়ে চলে যাবে বাসটা। 
ওই যে, তোমার বাস চলে এসেছে!
হে, তাই তো দেখছি, আনন্দ কবে আসবে আবার এ পথে?
কেন? আবার আসতে বলছ? 
হে!
এই হে, শব্দটা কত সহজেই বলে দিল শামীমা মুখের ওপর, ভেবেই পাই না আমি। 
আসব, ইচ্ছে হলেই চলে আসব!
আমি অপেক্ষায় থাকব! 
মানে, কী!
শামীমা কিছু না বলেই চলে গেল, বাসটা গিয়ার লাগিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে, শামীমা জানালার পাশের সিটে বসে মুঠোফোনে কথা বলছে। কথা বলার ফাঁকে আমাকে দেখছে, আবার কথা বলছে হয়তো ওর স্বামীর সঙ্গে।
কথা বলার ফাঁকে জানালায় মুখ ডুবিয়ে হাত নাড়িয়ে আমার দিকে হাসছে। নাকে একটা পাথরের নাকফুল পড়েছে শামীমা, ও হাসলে ওর ঝকঝকে দাঁতগুলো অনেকটাই বেরিয়ে আসে। হাসিটা যেন প্রাণবন্ত করে রাখে চারপাশটা। এসব বলতে বলতে বাসটা শামীমাকে নিয়ে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। এদিকে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, নেদু মিয়ার দোকানের মিষ্টি আর পরোটার বিলটাও মিটিয়ে গেছে শামীমা। আমি খুব একটা জোর করিনি, দেখ না। এমন সময় নেদু মিয়া নিজে রতন পাতি জর্দা দিয়ে একটা পান ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে, সেই পান চিবুতে চিবুতে রওনা হয়ে গোলাম বাড়ির দিকে। স্কুলটা বন্ধ এখন, চারপাশটা ঘিরে একটা সুনসান নির্জনতা, ধুলোর ওপর অনেকগুলো কচি পায়ের ছাপ, হয়তো একটু আগেই ছেলেমেয়েরা খেলা শেষে বাড়ি ফিরে গেছে। সেই ছেলেটাকেও আর কোথাও দেখলাম না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একটা আস্ত সিগারেট টেনে শেষ করে ফিরে এলুম। সন্ধের পর জঙ্গলের পথটা কিছুটা অস্পষ্ট দেখা যাওয়ায় হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলাম। মজার ব্যাপার হলো, দিনে জঙ্গলের যে ঘ্রাণটা থাকে রাতে সেই ঘ্রাণটা আরো দ্বিগুণ হয়। কেননা, অনেক ফুল আছে যারা সন্ধ্যার পর ফোটে, বাহারি বৃদ্ধ পাতারা ঝরে যায় বোঁটা থেকে। রাস্তার মাঝখানে দুটো বুনো শেয়াল আলোর প্রতিবিম্ব পেয়েই দৌড়ে পালিয়ে গেল। এমন পরিবেশে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে উদিসার কথা খুব মনে পড়ে গেল, শামীমার শেষ কথাটাও অপেক্ষায় থাকব। উদিসার মুখের ভীষণ কমন প্রলাপ ছিল এটা। 
এদিকে শামীমা যে ইউনিভার্সিটিতে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ভালোবাসত, তা ওর বচন দেখেই বুঝেছি। এখনো হয়তো সে ভালোবাসে আমাকে, হয়তো কেমিস্ট্রির সেই বিক্রিয়াবিদকে ফেলে আমার হাত ধরে পালাতে চাইবে সে। আদতে মানুষের মনের পরিবর্তনটা খুবই সাবলীল একটা বিষয়। এই্ যেমন ধরুন আমি নিজেই ভেবেছিলাম বাকি জীবন উদিসার স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই আমি কাটাব কিন্তু শামীমার ওই কথাটা যে মুহূর্তে আমাকে বলেছে তখনি আমার সমস্ত ভাবনারা কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। শামীমার মাঝে অন্য রকম এক উদিসাকে খুঁজে পেলাম আমি, আমি হয়তো আর দু-এক দিনের মধ্যেই শামীমার স্কুলের পথেই রওনা হব। হয়তো আর কাউকে আর অপেক্ষায় রাখতে চাই না আমি। না না আমি আর শামীমার স্কুলে যাব না, সে বিবাহিত, তা ছাড়া উদিসাকে ভুলে শামীমা এ হতে পারে না। এসব আবোলতাবোল কী ভাবছি আমি...?