
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে এসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি (উপাচার্য) অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) বিকালে নিজ কার্যালয়ে প্রোভোস্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের সামনে আসেন ভিসি। এ সময় আবরার হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে নীতিগত সমর্থন জানান ভিসি।
তিনি বলেন, তোমরা যে দাবিগুলো করেছে, আমি সেই দাবিগুলো মেনে নিয়েছি। আমি তোমাদের দাবির সঙ্গে নীতিগত সমর্থন জানাচ্ছি। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।
এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, যতদিন দাবি পূরণ দৃশ্যমান না হয়, ততদিন ক্যাম্পাসে কোনও কার্যক্রমে অংশ নেবেন না তারা। ভর্তি কার্যক্রমও স্থগিত রাখার দাবি তাদের।
ভিসিকে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করেন, আবরার হত্যার ঘটনার পর তিনি কেন ক্যাম্পাসে আসেন নি?
জবাবে ভিসি বলেন, আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দিতে শুরু করেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বার বার আশ্বস্ত করে ভিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, তোমাদের আন্দোলনের সাথে আমার নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তোমাদের দাবিনামা আমি পেয়েছে। দোষীদের অবশ্যই শাস্তি হবে। বুয়েট থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে। সব দাবি বাস্তবায়নে আলোচনার খুব শিগগিরই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
ক্যাম্পাসে দাঙ্গা পুলিশ কেনো এই প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, পরিস্থিতি আমার হাতে নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সরকারের সাথে এ নিয়ে কথা বললো।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ভিসি বলেন, আমরা তোমাদের সাথে এ নিয়ে বসবো। তোমাদের কোনও আল্টিমেটাম দিতে হবে না। তবে শিক্ষার্থীদের দাবি মানার বিষয়ে প্রকাশ্য ব্যাখ্যা দিতে রাজি হন নি ভিসি।
আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগে ভিসি বলেন, এ ঘটনার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলে কথা বলে ব্যবস্থা নিয়েছি। বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। তিনি আবারও বলেন, তোমরা যে দাবিগুলো দিয়েছ, আমি দেখেছি, আমি ৫-৬ জনকে নিয়ে বসবো। তোমাদের সব দাবি মেনে নিয়েছি।
ভিসি আর বলেন, তোমরা অধৈর্য্য হয়ো না, তোমাদের জন্য আমি আছি। আমি না আসলেও কাজ করেছি। ধৈর্য ধরো। আস্তে আস্তে সব হবে।
ফাহাদ হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিলের আগে পর্যন্ত বুয়েটের পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ এবং আন্দোলন চলমান থাকবে বলে ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ফাহাদ হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হতে হবে।
ভিসির সঙ্গে ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক মিজানুর রহমান ও একাধিক হল প্রভোস্ট উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে রাতে বুয়েট এলাকায় মশাল মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা।
এর আগে মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিকাল ৫টার মধ্যে উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে আসার আলটিমেটাম দেন। তিনি না এলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা করা হবে বলেও শিক্ষার্থীরা জানান। বিকেলে ক্যাম্পাসে এসেই হল প্রভোস্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলাম। এ সময় খবর পেয়ে তার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। তারা আলটিমেটাম দেন হয় ভিসিকে নিচে আমতে হবে, নাহয় তারা সবাই ভেতরে প্রবেশ করবেন।
আবরার হত্যার খবর জানাজানির পর শিক্ষার্থীরা বারবার উপচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বললেও তা আমলে নেন নি হল প্রাধ্যক্ষ। সোমবার (৭ অক্টোবর) রাতে ক্যাম্পাসে আবরারের জানাজায়ও ছিলেন না উপাচার্য। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) বিক্ষোভ মিছিলে ভিসির বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন তারা। তাদের সাথে সংহতি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও।
ফাহাদের মৃত্যুর ৩৬ ঘন্টা পর ভিসি বুয়েট ক্যাম্পাসে আসায় শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এক পর্যায়ে ক্যাম্পাসের সকল গেটে তালা দিয়ে বের হওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দেয় শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ভিসির কার্যালয় ঘেরাও করে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
এর আগে দুপুরে প্রতীকি কফিন নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থী। এ সময় বুয়েট শিক্ষক সমিতির শিক্ষকরাও আন্দোলনে অংশ নেন। বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তারা ফাহাদ বিচার এবং বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষনাসহ ৮ দফা দাবি জানানো হয়।
গত রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আবরারকে তার শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর রুম থেকে ডেকে নেন। বুয়েট শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ওই হলেরই ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে আবরারকে তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে আবরারের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢামেক মর্গে।
ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মরদেহ আনা হয় বুয়েট ক্যাম্পাসে। সেখানে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে রাত পৌনে ১০টার দিকে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও ক্যাম্পাসে আসেন নি উপাচার্য ড. সাইফুল। আবরারকে দেখতে আসাই নয়, আবরারের পরিবারের সঙ্গেও কোনও যোগাযোগ করেন নি বুয়েট উপাচার্য।
সোমবার রাতে ঢামেক মর্গে ছেলের মরদেহ নিতে আসা বরকতউল্লাহও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ছেলেকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর একবারের জন্যও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক।
এইচএম/এসএমএম