একটা বিষয় আমাকে অত্যন্ত শঙ্কিত করেছে। যতই ভাবছি ততই বিপন্ন এবং অসহায় বোধ করছি। শেখ হাসিনা প্রায়শই তাঁর অবসর নেওয়ার কথা বলে থাকেন। এই অবসরের ব্যাপারে তিনি যদি অবিচল থেকে যান তাহলে তাঁর অবর্তমানে নেতৃত্ব যাদের ওপর অর্পিত হবে, তাদের মাধ্যমে দেশের কী পরিণতি দাঁড়াতে পারে-সেটা ভেবে আশঙ্কিত হতেই হয়। প্রিয়া সাহা গত দুদিন ধরে টক অব দ্য কান্ট্রি। তার ঘটনাটি গত কয়েকদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে যেভাবে তোলপাড় করেছে এবং যেভাবে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে প্রিয়া সাহার রাষ্ট্রদ্রোহিতা কিংবা তার বিচারের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন— সেটা শুভবোধবুদ্ধি সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে শুভবার্তা বয়ে আনছে না। আর এসব নেতাদের নেতৃত্বে যদি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ পরিচালিত হয়, তাহলে কী পরিণতি হবে-সেটা ভেবে আমি শঙ্কিত বোধ করছি।
পুরো ঘটনার নেপথ্য কিছু ব্যাপার একটুখানি বুঝতে চেষ্টা করা যাক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগের ভিডিওটি প্রথম ফেসবুকে ছড়ায় জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ‘বাঁশের কেল্লা’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানে শুরুতে ভিডিও পোস্ট করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গালাগাল করে বলা হয়, যে হিন্দুরা সকাল সন্ধ্যা আওয়ামী লীগ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না সেই হিন্দুরা এখন ট্রাম্পের কাছে বিচার দিচ্ছে।’
১৮ জুলাই রাত থেকে ভিডিওটি বাঁশের কেল্লার একাধিক অ্যাকাউন্ট ও তাদের সদস্যদের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করার পর বিএনপি ও অন্যান্য দল এমনকি আওয়ামী লীগ ও সাধারণ লোকজনও এতে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। এক পর্যায়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার ফেসবুক পৃষ্ঠায় প্রিয়া সাহার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। প্রিয়া সাহাকে নিয়ে সরকারের আপাতত প্রতিক্রিয়া সেখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু ২০ জুলাই সরকারের বেশ ক’জন মন্ত্রী প্রিয়া সাহার বক্তব্যের ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। এমনকি সরকারের মন্ত্রীরা প্রিয়া সাহাকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। ২০ জুলাই সাংবাদিকদের একটি গ্রুপ সংঘবদ্ধভাবে মিডিয়াতে প্রচার করে, আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর প্রিয়া সাহার বক্তব্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন। ওই খবরের ভিত্তিতে মন্ত্রীরাও বলেন, আমেরিকান অ্যাম্বাসেডরও প্রিয়া সাহার বক্তব্য সমর্থন করেননি। এটাও যে একটা প্রগাগান্ডা ছিল সেটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। ফলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমেরিকান অ্যাম্বাসেডরের বরাত দিয়ে প্রিয়া সাহার বক্তব্য নাকচ করার খবর ফেসবুকে প্রচার হওয়া শুরু করলে আমেরিকান অ্যাম্বাসি মিডিয়া অফিসগুলোতে ফোন করে বলতে থাকে, অ্যাম্বাসেডর প্রিয়া সাহার বক্তব্য নিয়ে কোনো কিছু বলেননি। এরপর আবার জামায়াত-শিবিরের বাঁশের কেল্লা অ্যাকাউন্ট থেকে উল্লাস প্রকাশ করে প্রচার করা হয়, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা আমেরিকান অ্যাম্বাসেডরের বক্তব্য জালিয়াতি করে ধরা খেয়েছে।
২১ জুলাই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় অতি উৎসাহীরা প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে মামলা করেন। তবে পরিস্থিতি বদলে যায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রিয়া সাহার কাছ থেকে ব্যাখ্যা পাবার আগে তার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। বিষয়টি ঘাপটি মেরে থাকা বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের হতাশ করে। প্রিয়া সাহাকে নিয়ে হুমকি ধামকিতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যেখানে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় প্রিয়া সাহার বিরূদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ প্রিয়া সাহা আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কাছে যে কথা বলেছেন তা তারা এ দেশে অহরহ বলে থাকেন। এগুলো মিডিয়াতেও এসেছে। প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রান্ত সংখ্যালঘু নেতাদের বলতে শোনা গেছে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই যদি এমন হয় তবে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসলে কি হতো?
.................................................
‘‘এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চমৎকার একটি উদাহরণ তৈরি করেছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে যদি কোনোভাবে ষড়যন্ত্র করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যায় তবে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোই একসময় মুক্তিযুদ্ধের অসম্প্রদায়িক চেতনাকেও বিপন্ন করে তুলবে, শেষাঙ্কে বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি ধ্বংস হবে সম্পূর্ণভাবে’’
.................................................
২১ জুলাই ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনার নির্দেশনা জানানোর পর তারাই আবার বলেছেন, এ দেশে যে ব্যক্তি তাদের আশা-ভরসা সেই এবার আবারও তাদের বাঁচালেন। এখন প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দেখালেন তা অন্য মন্ত্রীরা কেন দেখাতে পারলেন না? আমার শঙ্কার বিষয়টি এ জায়গাতেই।
মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রতিবেশি দেশসমূহ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে শেখ হাসিনা যে সর্ম্পক কয়েক দশক ধরে দক্ষতা এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে তৈরি করেছেন, সেটা নষ্ট হওয়া বাংলাদেশের জন্য কখনই শুভ হবে না। কেবল বাংলাদেশ নয়, এতে করে পুরো উপমহাদেশে নতুন করে সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত হতে পারে। শেখ হাসিনা যদি তাঁর উত্তরসূরি এসব নেতাদের সংশোধিত না করেন তাহলে আমি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কথা বলছি না, এর প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে আরো বহু দূর পর্যন্ত। আমার দ্ব্যর্থহীনভাবে মনে হয়েছে, যেসব আওয়ামী নেতা নিজেদের মতো করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারা এখনো নিজেদের প্রস্তুত এবং যোগ্য করে তুলতে পারেননি। তাদের অপরিপক্ব কিংবা অপরিণত এসব বক্তব্য প্রমাণ করে— শেখ হাসিনার ভবিষ্যতের শূন্যস্থানটি কত বিশাল একটি শূন্য হয়েই রয়ে গেছে। সেটা পূর্ণ করার মতো কেউ নেই। মনে রাখতে হবে, তরুণ নেতৃত্ব যেমন আসবে, তেমনি সেই সকল নেতাদের রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব হতেই হবে। কিছু কিছু ঘটনা তাদের জন্য অ্যাসিড টেস্টের মতো। সুতরাং এসব ব্যাপারে তাদের আরো প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, যারা অত্যন্ত নিপূণভাবে বাংলাদেশ-বিরোধী চক্রান্ত সাজিয়েছে এবং আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত তৈরি করেছে, এই জায়গায় এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওই সকল অযোগ্য এবং অপরিণত নেতাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে দেশবিরোধী চক্র মানুষকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করতে পারছে। কিছু কিছু সুযোগসন্ধানী আইনজীবী আছেন, যারা কোনো কিছুতে ইস্যু পেলেই উঠেপড়ে লাগেন। প্রিয়া সাহার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক মামলা হয়েছে এবং আরো হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে মামলাবাজরা নড়ে চড়ে বসেছেন। এতেও বোঝা যায় কীভাবে চারিদিকে সুযোগসন্ধানী লোকজন ওত পেতে আছে।
আমি শঙ্কিত এ কারণে যে, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের যে ভূমিকা ছিল, এমন পরিস্থিতিতে কতিপয় মন্ত্রীর এই ধরনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সংগতভাবে শঙ্কার সৃষ্টি করবে। এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চমৎকার একটি উদাহরণ তৈরি করেছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে যদি কোনোভাবে ষড়যন্ত্র করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যায় তবে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোই একসময় মুক্তিযুদ্ধের অসম্প্রদায়িক চেতনাকেও বিপন্ন করে তুলবে, শেষাঙ্কে বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি ধ্বংস হবে সম্পূর্ণভাবে। এই ষড়যন্ত্রটি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ভেতরে অনুপ্রবেশ করে কিংবা তাদেরকে বিভ্রান্ত করে যে ঘোলা পানি সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শেখ হাসিনাকে নতুন করে ভাবতে হবে— কোন শক্তি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে রাখবেন। কারণ শেখ হাসিনার ওপর শুধুমাত্র বাংলাদেশ এখন নির্ভর করে না, নির্ভর করে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষ। এই বিষয়টি বুঝতে হবে।
শেখ হাসিনার গুণকীর্তনের জন্য বলছি না, আমি বলছি বাস্তব পরিস্থিতি। শেখ হাসিনার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি বাংলাদেশের কী ব্যবধান সৃষ্টি করবে, কিছু কিছু ঘটনার ভেতর দিয়ে আমরা সেটা অনুধাবন করতে পারছি। অনুধাবন করে আতঙ্ক বোধ করছি। সুতরাং বিষয়টি যদি সংশোধন না করা যায়, তাহলে এটা বিশাল একটা সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, শুধু বাঁশের কেল্লা নয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমের মধ্যে আমরা যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছি এবং সেখানে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরনো যেই সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ নতুন করে রোপণ করার যে অপপ্রয়াস লক্ষ্য করছি, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। সুতরাং শেখ হাসিনার অবর্তমানে কোথায় যাব আমরা- সেটা এখন কল্পনা করাটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের সমান।
লেখক ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ