পনেরোই আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনের কলঙ্কতম দিন। ১৯৭৫-এর এই দিনে বাঙালি জাতির শৃঙ্খল মোচনের মহাসংগ্রামের স্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। আর এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে বিধ্বস্ত করা, বাঙালি চেতনাকে বিনষ্ট করা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বোধকে সংহার করার এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের সূচনা করা হয়েছিল। এটা শুধু একটি দিনের ষড়ষন্ত্র নয়। তিল তিল করে যে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল তারই উলঙ্গ প্রকাশ ছিল পনেরোই আগস্ট। আমরা যদি ষড়যন্ত্রের ইতিহাসকে ভালোভাবে অনুসন্ধানের চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাব পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকেই অনেক কাশিমবাজার কুঠির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সেগুলো ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। পনেরোই আগস্টকে সামনে রেখে আমরা এমন কিছু তথ্য পরিবেশন করব, যা ইতিপূর্বে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি, কিংবা আংশিক অথবা বিকৃতভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, যা দীর্ঘ সময় জাতিকে বিভ্রান্ত রেখেছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিন ধরে ষড়যন্ত্রের পাকে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর সূচনা কিন্তু শুধু বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় থেকেই নয়, তার অনেক আগে থেকেই। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর থেকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রীতিমতো পাখা বিস্তার করতে থাকে, যার পরিণতি আমাদের ধারাবাহিক সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ। এই ষড়যন্ত্র যেভাবে শুরু হয়েছে সেই ইতিহাসকে যদি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরতে হয়, তাহলে তার পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত হবে। তাই আমরা সেখানে না গিয়ে শুধু একাত্তর থেকেই শুরু করতে চাই।
পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন - ফাইল ছবি
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের কয়েক দিন পরই বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন, আসলে ওই মুক্তি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুক্তি ছিল না। ছিল চক্রান্তমূলকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র। তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করার একটি পরিকল্পনা ছিল, যা সেই সময় জেনে ফেলেছিলেন কারাগারে বঙ্গবন্ধুর পরিচর্যার জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত দায়িত্বে তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রেখে দেন। এই ষড়যন্ত্র কার্যকর না হওয়ায় জুলফিকার আলীর ঘাতক মস্তিষ্ক আরেকটি হত্যা পরিকল্পনা শুরু করে। এই বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি প্রয়াত এক বিশিষ্ট ভারতীয় সাংবাদিক পরেশ সাহার গ্রন্থ থেকে। তার সংগৃহীত তথ্যসমূহ আমরা সংকলন করেছি এবং পরিমার্জন ও আরো কিছু তথ্য সংযোজন করে পরিবেশন করছি।
দুই.
সহযাত্রী ছিল ঘাতকের দল
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তান জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যাত্রা করেন। বাস্তবে আমরা যেটা দেখি যে বঙ্গবন্ধুকে জুলফিকার আলী ভুট্টো কারাগার থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বাহবা কুড়ানোরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভুট্টোর মতো একজন নির্দয়, নিষ্ঠুর ঘাতক যিনি এই ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকাণ্ডের জন্য পরবর্তীতে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলেছিলেন, তার সেখানেই থেমে থাকার কথা নয়। ভুট্টোর পরবর্তী পরিকল্পনাটি ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়েছিল ঠিকই, নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথাও প্রকাশ করা হয়েছিল তখনকার পত্রপত্রিকায়। কিন্তু সেটা ছিল আরেকটি সাজানো ছক। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন যাত্রা করেন, সেই একই দিনে এবং একই বিমানে লন্ডনে পাঠানো হয় পাকিস্তানের একটি হকি দলকে। এই একই বিমানে হকি দলটিকে লন্ডনে পাঠানোর পরিকল্পনাও ছিল ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। এই দলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল এমন কয়েকজন ছদ্মবেশী ব্যক্তিকে, যারা হকি খেলোয়াড় ছিল না। তারা ছিল ভুট্টোর গোপন আদেশ কার্যকর করার সংঘবদ্ধ ঘাতক চক্র। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু বিমানে আরোহণ কিংবা বিমান অবতরণের কোনো এক মুহূর্তে যেন হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য যাদের লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল, এই ঘাতক দলের প্রধান ছিল এই দেশেরই কুলাঙ্গার। তার নাম দবির উদ্দিন সিদ্দিকী। এই দবির উদ্দিন সিদ্দিকী ঢাকা জেলার বলিয়াদী গ্রামের এক ধনী পরিবারের সন্তান।
পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তনের পর তেজগাঁও বিমানবন্দরে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-ফাইল ছবি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসেন। সেই ঘাতক দল একই বিমানে থাকা সত্ত্বেও লন্ডনে তার ওপর আঘাত করার কোনো সুযোগ পায়নি। কারণ, লন্ডনে শেখ মুজিবের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি ছিল খুবই তীব্র এবং তীক্ষ্ণ। ভারতীয় গোয়েন্দারা আগে থেকে পুরো ব্যাপারটির খবর পেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু নিরাপদ নন। কাজেই তারা তাঁর নিরাপত্তার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু যখন ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় চলে এলেন, তখন ঘাতক দল তাকে আর আক্রমণ করার সুযোগ পেল না। কিন্তু তাই বলে সেখানেই তারা বসে থাকেনি।
বঙ্গবন্ধুর আবার কোলকাতা যাওয়ার কথা ছিল ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি ভাষণ দিলেন। এই সময়ও পাকিস্তানি গুপ্তঘাতক দল একটা ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হয় এবং তাদেরকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর অনেক জেরার পরে কথিত দবির উদ্দিন সিদ্দিকী ওই গোয়েন্দাদের কাছে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দেয়। ১২৭ পৃষ্ঠার ফুলস্কেপ কাগজে টাইপ করা ওই বিবৃতিতে সে তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে। বিবৃতিতে সে জানায়, সে পাকিস্তানি গোয়েন্দা চক্রের লোক। শেখ মুজিবকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দপ্তর তাকে নিয়োগ করেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন কোলকাতায় যান, তখনই তাকে দবির উদ্দিনের কথা বলা হয় এবং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বিস্তারিত জানানো হয়। দবির উদ্দিন সিদ্দিকীকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে সেই দবির উদ্দিন সিদ্দিকী জেলের বাইরে চলে এসেছিল একটি বিশেষ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সে পরপর তিনবার অথবা চারবার বাংলাদেশের একটি অভিজাত ক্লাবের সভাপতির পদে নির্বাচিত হয়েছিল। পল্টন মোড়ে অবস্থিত একটি অভিজাত হোটেলের মালিকানাও তার ছিল। এই দবির উদ্দিন সিদ্দিকী সব সময় খুব রহস্যজনকভাবে চলাফেরা করত। বর্তমানে সে প্রয়াত। কিন্তু ষড়যন্ত্রের জালের প্রাথমিক যে চিহ্ন রেখে গেছে, তা থেকেই বোঝা যায় এই ষড়যন্ত্রের শেকড় কত গভীরে ছিল।
জুলফিকার আলী ভুট্টো - ফাইল ছবি
ওই সময়টায় জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হন। সে সময় তিনি বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছিলেন তার নিজের রাজনীতির উচ্চাশা বাস্তবায়ন করার কাজে। ভুট্টো সাহেব ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশেও এসেছিলেন। ইতিমধ্যে পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রকারীরা নানা অপকর্মের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। তার নেপথ্যের একজন ছিলেন এই জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তিনি ঢাকায় এসে যে কাজগুলো করেছেন তা কোনো সম্ভ্রান্ত অতিথির পক্ষে সৌজন্যমূলক তো নয়ই, বরং বিধিবহির্ভূত কার্যক্রমও বটে।
তিন.
ঘরের মধ্যে কেউটে সাপ
আমরা এখন চলে যাব একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়টাতে। তখন বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে পুরোদমে। স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকারও গঠিত হয়েছে। সেই সরকারের বিদেশমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ পদটি পেয়েছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। এই পদটি তিনি কীভাবে পেলেন সেটাও একটা রহস্যজনক ব্যাপার। আবার সে সময় বিস্ময়করভাবে মাহবুবুল আলম চাষী নামের পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন একজন আমলা বিদেশ সচিবের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। এরপর কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নাটকের সূত্রপাত ঘটল।
কে এই মাহবুবুল আলম চাষী? মাহবুবুল আলম চাষী ছিলেন পাকিস্তানের বিদেশ দপ্তরের একজন ঝানু অফিসার। আমেরিকায় পাকিস্তানি দূতাবাসে কাজ করার সময় একশ্রেণির মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তার মাখামাখি ছিল। তাদের ভেতরে কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা চক্র সিআইয়ের কয়েকজন অফিসারও ছিল। পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে মাহবুবুল আলমের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। কোনো দিনই সে সম্পর্কে কোনো রকম ভাটা পড়েনি। একসময় মাহবুবুল আলম পাকিস্তানের আইয়ুব মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঘনিষ্ঠও হয়ে ওঠেন।
’৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সে সময় যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বিশাল গণ-আন্দোলন শুরু হয়, এই সময় ঝোপ বুঝে মাহবুবুল আলম চাষী অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করে তিনি তাড়াতাড়ি সরকারের উর্দিটা খুলে ফেলেন এবং পুরোপুরি বেসরকারি হয়ে যান। তার নামের শেষে তখনই তিনি চাষী তকমা যুক্ত করেন। চট্টগ্রাম শহর থেকে কিছু দূরে একটা চাষের খামার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সবুজ বিপ্লব করার কার্যক্রম শুরু করেন। আর কুমিল্লা শহরে ছিল তার একটা ডেরা। নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে সেই সময় তিনি কুমিল্লা-চট্টগ্রামের পথে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেই মাহবুবুল আলম চাষী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরে কীভাবে উড়ে এলেন, আর কীভাবে জেঁকে বসলেন, সেটা এখনো রহস্যজনক। শুধু বসা নয়! একেবারে বিদেশ দপ্তরে। যেখান থেকে বাইরে হাত বাড়ানো এবং বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুবই সহজ ছিল। মাহবুবুল আলমও তাই করলেন।
এই মাহবুবুল আলম চাষী পরবর্তী পর্যায়ে কী ভূমিকা পালন করেছেন, সেগুলো আমরা পরবর্তীতেই আলোচনা করব। এই মুহূর্তে আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এটা হচ্ছে মার্কিনদের তকমাধারী খন্দকার মোশতাক মাহবুবুল আলম চাষীর মাধ্যমেই সিইআইয়ের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি কোলকাতার মার্কিন কন্সাল জেনারেল মি. গর্ডনের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের যোগাযোগ করিয়ে দেন। এ সম্পর্কে প্রয়াত সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তাঁর ‘বাংলাদেশ ইন ব্লাড অ্যান্ড টিয়ার্স’ শিরোনামের গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে লিখে দিয়েছেন এবং একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে আমি ক’জন সাংবাদিক, বন্ধু ও সহকর্মীকে নিয়ে কোলকাতার গ্রান্ড হোটেলে পান-ভোজন সারছিলাম।... কয়েক ‘পেগ’ গলায় ঢালার পর আমি লক্ষ্য করলাম মাথায় গোল টুপিপরা আমার বিশেষ পরিচিত এক ব্যক্তি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছেন। তিনি আর কেউ নন, মুজিবনগরের অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিদেশমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। গ্লাসটি একপাশে সরিয়ে রেখে আমি দ্রুত ছুটলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। আমায় দেখে তিনি একটু হাসলেন, আমায় আলিঙ্গন করলেন। বললেন, ক’জন বন্ধুর সঙ্গে এই হোটেলে তার একটা ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ আছে। হঠাৎ তার পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন খুব লম্বা একটা মানুষ। তাকে আমি জানি, কোলকাতার মার্কিন কন্সাল-জেনারেল মি. গর্ডন। তার সঙ্গে ছিলেন আরো একজন আমেরিকান, তার পরিচয় আমি জানিনে। হাত তুলে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মি. গর্ডন ওই ব্যক্তিকে নিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলেন। লিফটের দিকেই গেলেন। খন্দকার মোশতাক সাহেবও ছুটলেন তাদের পিছু পিছু। এমন সময় জনৈক বাঙালি ভদ্রলোক আমাকে অনুরোধ করলেন, মি. গর্ডনের সঙ্গে আমেরিকান লোকটি কে, তা আমি তাকে জেনে দিতে পারি কি না। আমি উপরে গিয়ে আমেরিকানদের নাম জানলাম এবং তা ওই বাঙালি ভদ্রলোককে বলে দিলাম। ওই বাঙালি ভদ্রলোকটি সম্ভবত ভারতীয় কোনো গোয়েন্দা সংস্থার লোক। তিনি আমাকে বললেন, ওই হোটেলে অনেক ঘটনাই ঘটছে। এক বর্ষীয়সী মার্কিন মহিলা সেখানে কয়েক কামরার একটা ‘স্যুইট’ ভাড়া করেছেন এবং সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক লোকের যাতায়াত হচ্ছে (পৃষ্ঠা নং-৪৫)।”
ওইদিন খন্দকার মোশতাক আহমেদ আলোচনার জন্য নিশ্চয়ই তার মার্কিন দোস্তদের কাছে গিয়েছিলেন, আর কোনো উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কোন বিষয়ে আলোচনা? মার্কিন কন্সাল জেনারেল মি. গর্ডনের সঙ্গে যে মার্কিন ভদ্রলোক গিয়েছিলেন তিনিই বা কে?
‘এই গ্রান্ড হোটেলে সে সময় আর কারা যাতায়াত করতেন এ তথ্যও কিন্তু আজকে আর গোপন নেই। সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান, মুন্সিগঞ্জের শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মহম্মদ খালেদ, এরা দিনরাত সেখানে গিয়ে মিলিত হয়ে নানা রকম আলোচনা করতেন। আর সেখানে সবকিছুর ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ওই মাহবুবুল আলম চাষী। সেখানে কখনো কখনো মার্কিন অফিসারদের যাতায়াত হতো, সে কথাও জ্যোতি সেনগুপ্ত তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি কোলকাতা মিশনে গিয়েছিলাম হাইকমিশনার হোসেন আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আমার সঙ্গে ছিলেন লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার একজন সাংবাদিক।আমাদের এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দুজন মার্কিন ভদ্রলোকের সঙ্গে হোসেন আলী কথা বলছিলেন এবং সেই সুদীর্ঘ আলোচনার শেষে তারা বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমাদের ডাক পড়েছিল (পৃষ্ঠা নং-৪৫)।’
এটা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের সূচনালগ্নের একটি ক্ষুদ্র অংশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ষড়যন্ত্র যে আরো কত ব্যাপক বিস্তারিত হয়েছে, সেটি আমরা এর পরবর্তী পর্বে আরো ভালোভাবে আলোচনা করব।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।
বি.দ্র. পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ৪ আগস্ট।