• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০১৯, ০৮:৩৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৭, ২০১৯, ০৯:৪৫ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (দুই)

ইয়াহিয়ার সঙ্গে আঁতাতের পরিকল্পনা

ইয়াহিয়ার সঙ্গে আঁতাতের পরিকল্পনা


বঙ্গবন্ধুর প্রাণ সংহারের ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত কেবল যে একাত্তরে হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকেই তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করার জন্য একের পর এক বিকল্প রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। সেটা তদানীন্তন পাকিস্তানের এই অংশেও যেমন, অন্য অংশেও তা-ই। এই অংশে বিকল্প তেমন কোনো ব্যক্তিত্বকে কার্যকরভাবে দাঁড় করানো না গেলেও অন্য অংশে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরতে সফল হয়েছিল পাক গোয়েন্দা চক্র।

ষাটের দশকের শেষাংশে আইয়ুব মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে ভুট্টো সাহেবের বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন এবং সেটাকে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাইয়ে দেয়ার পেছনে পাক-মার্কিন গোয়েন্দা চক্রের যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল, পরবর্তীতে ভুট্টোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি এই বাস্তবতার উজ্জ্বল সাক্ষী। এরই প্রমাণ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সুযোগে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বন্দি অবস্থায় নানা কৌশলে হত্যার চেষ্টা। এমনকী একসময় ফাঁসিতে ঝোলানোর চক্রান্তও হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, একাত্তরে পাকিস্তানের কারাগারেও একই ধরনের চেষ্টা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরার পর থেকে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের নারকীয় ঘটনার সময় পর্যন্ত নানাবিধ ষড়যন্ত্র চলেছে নানা ফ্রন্টে। সবকিছুরই লক্ষ্য ছিল দেশটাকে অকার্যকর করা, মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে কলঙ্কিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে হত্যা করা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সংবিধানে উল্লিখিত ধর্মনিরপেক্ষতার মানবিক নীতিকে ব্যর্থ করে দেয়া এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটানো। এই ষড়যন্ত্রের এক পর্যায়েই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করা হয় এবং কারাগারে আটক মুক্তিযুদ্ধের চার বীরসেনানী নায়ককে হত্যা করার ভেতর দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছিল পাকিস্তানেরই অবয়ব। আমরা নানাবিধ তথ্য-প্রমাণের ভেতর দিয়ে এই সত্যকে উদ্‌ঘাটনেরই চেষ্টা করেছি।

ইয়াহিয়া খান

ফিরে আসি সেই কথায় যা বলছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রহস্যজনকভাবে ঠিক হলো, বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে বক্তব্য রাখার জন্য অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ নিউইয়র্ক যাবেন। তার সঙ্গে যাবেন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী। কিন্তু এটা বহিরাবরণ মাত্র। তাদের আসল মতলবটা ছিল অন্য রকম। নিউইয়র্ক গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে চান। ইয়াহিয়ার কাছে তাদের ‘আপিল’ যদি মঞ্জুর হয়, তাহলে তারা আর মুজিবনগরমুখী হবেন না। সেখান থেকেই ওই জুটি উড়াল দেবেন ঢাকায়। ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়েই তারা ঘোষণা করবেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের কনফেডারেশনের কথা। তাদের এই ষড়যন্ত্রের কথাটা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কানে যায়। কানে যায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামেরও। সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের বিদেশ সফর বাতিল করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এর ফলে খন্দকার মোশতাক হারান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ। এভাবেই যে সাপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বুকে ছোবল মারতে বিষধর ফণা তুলেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতায় সে ফণা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা দমে যায়নি। ভেতরে ভেতরে সক্রিয় ছিল সব সময়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় কোলকাতায় যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হলেও সেই চক্রান্ত থেমে থাকেনি। শুধু তার স্থান বদল হয়েছে। চক্রান্তকারীদের হেডকোয়ার্টার সরিয়ে নেয়া হয় কোলকাতা থেকে ঢাকায়। তার কুশীলব সব ঠিকই ছিল। রিং মাস্টার আগের মতোই সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই চক্রান্তের প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে তথা হাতুড়ি, বাটাল ইত্যাদি বহনের জন্য তার সঙ্গে যোগ দেয় পাকিস্তান ও আরব দুনিয়ার কয়েকটি ইসলামি রাষ্ট্র।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের পরাজয়ের শামিল

হেনরি কিসিঞ্জার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের পররাষ্ট্রনীতির পরাজয়ের শামিল। এ জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসনে কিসিঞ্জারের অবস্থা একসময় নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল কিসিঞ্জারের গভীর বিদ্বেষের মনোভাব। ‘বাংলাদেশ : দি অনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থের লেখক লরেন্স লিফশুলজ ‘আনসারটেন গ্রেটনেস : হেনরি কিসিঞ্জার অ্যান্ড আমেরিকান ফরেন পলিসি’ বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকায় ছিল তিনটি নাম- ‘আলেন্দে, থিউ ও মুজিব’ (বাংলাদেশ : আনফিনিশড রেভ্যুলেশন, পৃষ্ঠা-১৩৭)। এই হেনরি কিসিঞ্জার স্বাধীন বাংলাদেশকে কোনো দিনই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিদ্রূপ করেছিলেন। বাংলাদেশ যাতে অসুবিধায় পড়ে, সেজন্য তিনি সব দিক থেকে চেষ্টা করেছেন। তার এই মনোভাব অত্যন্ত নগ্নরূপে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার আচার-আচরণ ও ব্যবহারে। জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শরৎকালে বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্ক যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এটা হলো প্রথা যে, বন্ধুরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যদি প্রথমবার জাতিসংঘে ভাষণ দিতে আসেন, তাহলে মার্কিন সরকার তাকে রাজধানী ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানান। যেখানে তাঁর আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটে। মার্কিন সরকার নিয়মমাফিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে এক সরকারি ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানায়। সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিংবা সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের ভোজসভার আয়োজন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেলায় এই প্রচলিত বিধি ভঙ্গ করা হয়। প্রেসিডেন্ট কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী নন, ওই ভোজসভার আয়োজন করেন মন্ত্রিসভার নিম্নপদস্থ জনৈক অফিসার। মার্কিন কর্তাদের এই অবমাননাকর আচরণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রতিনিধিদল ওই ভোজসভা বর্জন করেন।

হেনরি কিসিঞ্জারের দুশমন শেখ মুজিব

১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে হেনরি কিসিঞ্জার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এটা তার প্রথম আগমন। তিনি ঢাকায় সর্বসাকল্যে ছিলেন মাত্র আট ঘণ্টা। ঢাকায় তখন বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্র অত্যন্ত তৎপর। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারে, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রেখে তার সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। ফলে তারা চরম অস্থিরতা এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধী মনোভাব তৈরির পরিকল্পনা করে। এই উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা যে কর্মসূচি গ্রহণ করে, একে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা চলে। ১. সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ২. সাম্প্রদায়িকতার প্রসার, ৩. ভারত বিরোধিতা তথা আওয়ামী লীগ বিরোধিতা, ৪. সারা দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কয়েকটি উগ্রপন্থী দল ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করে। এদের নেতৃত্বে খুন-জখম, থানা আক্রমণ, ডাকাতি ইত্যাদি ছিল নিত্যদিনের ঘট্না। এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারা দল। সিরাজ সিকদার ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, মার্কিন সাহায্যকারী এক সংস্থার কর্মী। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে গোটা পূর্ব বাংলায় তখন তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু হয়, তখনই তিনি ওই চাকরি ছেড়ে গোপনে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেন। এ সময়েই তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় সর্বহারা দল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে সিরাজ সিকদার লন্ডনে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে হঠাৎ তিনি হয়ে ওঠেন দুরন্ত বিপ্লবী। মার্ক্সবাদী, চীনপন্থী কমিউনিস্ট।

কিন্তু সিরাজ সিকদারের সর্বহারা দল জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কী করে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠল, সেটা এখনো একটা রহস্য। তবে প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য হতে না থাকলেও কোনো কোনো মহলের ধারণা, মার্কিন গোয়েন্দা চক্র সিআইএর সঙ্গে এই দলের কোনো কোনো নেতার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আর ওই চক্রের নির্দেশেই ওই দল সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার সংকট সৃষ্টির জন্য সশস্ত্র সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করে। দক্ষিণবঙ্গে তখন এমন কতগুলো ঘটনা ঘটে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলার ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয়।

মেজর জলিলের চক্রান্ত

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর এম এ জলিল ছিলেন খুলনা জেলার ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র পাওয়া যায়। সরকারের সন্দেহ, সেসব কাগজে যা লেখা ছিল সেগুলো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর নির্দেশ। কিন্তু মেজর জলিলের অনুরাগীরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং তারা এর অন্য ব্যাখ্যা দেন। সে যা-ই হোক, এই মেজর জলিলের ধারণা ছিল পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু আর ফিরবেন না। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হবে। মেজর জলিল তাই তখন একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় সাংবাদিক পরেশ সাহার সঙ্গে দেখা করেন মেজর জলিলের সেক্টরেরই তিন মুক্তিযোদ্ধা। তারা তাকে জানান, “গতকাল রাতে নাকি মেজর জলিল ‘অ্যাকশনে’ গিয়েছিলেন উনিশ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে। তাঁদের সবাই ধরা পড়েছেন পাক-হানাদারদের হাতে। জলিল সাহেব শুধু একাই ফিরে এসেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।”

মেজর জলিল

তাঁদের একজন হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলেন, ‘এটা ষড়যন্ত্র। জলিল সাহেব ইচ্ছে করেই ওই ছেলেদের নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি ফাঁদে ফেলেছেন। নইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে না।’

পরেশ সাহা তার বইয়ে লিখেছেন, “বলতে দ্বিধা নেই, মেজর জলিল সম্পর্কে সেদিন আমার মনেও একটা সন্দেহের কাঁটা ফুটেছিল। কেননা, ‘অ্যাকশনে’ গিয়ে উনিশ জন মুক্তিযোদ্ধাই যখন ধরা পড়লেন, সেখানে পাকিস্তানি ব্যুহ ভেদ করে একা জলিল বেরিয়ে এলেন কী করে? সুতরাং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করলে আমার সেই সন্দেহের কাঁটা আরও দৃঢ়মূল হলো।”

মেজর জলিলের গ্রেপ্তার নিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কিছুটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তার অনুসারীরা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। খুলনায় এককালের মুসলিম লীগের ক্যাডাররাও রাতারাতি জার্সি বদল করে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। ফলে খুলনা জেলার কোনো কোনো অঞ্চলে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। মেজর জলিল এক বছর আটক থাকার পর মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে এসে এই স্বঘোষিত মার্ক্সবাদী আবার রং পাল্টান। মার্ক্সবাদ ছেড়ে তিনি কট্টর মৌলবাদের কোলে গিয়ে আশ্রয় নেন। তবে জাসদের আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা ও সরকারবিরোধী আন্দোলন জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের মর্যাদা খানিকটা ম্লান করে। কেননা যাদের সমন্বয়ে জাসদ গঠিত হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ এবং এরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

শফিউল আলম প্রধানের ষড়যন্ত্র

১৯৭৩ সাল থেকেই ছাত্রলীগে পরিবর্তন দেখা দেয়। শফিউল আলম প্রধান তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সুবক্তা ও সুসাংগঠনিক শফিউল আলম ছাত্রলীগকে দাঁড় করান আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন হিসেবে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাঁর জিব থেকে অবিরাম বিষ ঝরতে লাগল। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সব মন্ত্রী ও নেতা দুর্নীতিপরায়ণ। দেশের মানুষ যখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, তখন তাঁরা চুরির টাকায় গড়ে তুলছেন বিষয়-বৈভবের আকাশছোঁয়া মিনার। ছাত্রলীগ ১৪ জন আওয়ামী লীগ নেতার সম্পত্তির একটা বানোয়াট হিসাব দিয়ে একটি ইশতেহার প্রচার করে। শুধু ওই ইশতেহার প্রচার করেই তাঁরা থেমে থাকেনি। ওইসব আওয়ামী লীগ নেতার ‘অসৎ’ কাজ বন্ধ করতে পল্টন ময়দানে আহূত এক জনসভায় তারা হুমকি দেন। ছাত্রলীগ প্রচারিত ওই ইশতেহারটি আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নষ্ট করে। ওই সময় বিরোধী দলগুলো সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করতে পারেনি, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে ছাত্রলীগ। অথচ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলমের বিরুদ্ধে দলবিরোধী কার্যকলাপের কোনো রকম অভিযোগ ওঠেনি।

শফিউল আলম প্রধান

এর পরই ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সাতটি খুনের ঘটনা। যারা খুন হলেন, তারা সকলেই যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থক। খুনির তালিকায় যেসব নাম উঠল তার প্রথম নামটিই হলো শফিউল আলম প্রধানের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন মস্কোয় চিকিৎসাধীন। এই সাত খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের ভেতরেই এমন উত্তেজনা দেখা দিল, যার ফলে যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। খবর গেল মস্কোতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। ঢাকায় ফিরে এসে সবার কাছে সব কথা শুনে পুলিশকে তিনি আদেশ দিলেন : ‘প্রধানকে গ্রেপ্তার করো।’

এই গ্রেপ্তারের পর প্রধানকে যেদিন আদালতে প্রথম হাজির করা হয়, শফিউল আলম আদালতে স্লোগান দেন : ‘খুনি মুজিবের ফাঁসি চাই।’
এই শফিউল আলম প্রধানের সত্যিকার পরিচয় কী? তিনি কি কোনো উগ্র সন্ত্রাসবাদী দলের ‘প্ল্যান্টেড ম্যান’? আওয়ামী লীগ ও তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাবমূর্তিকে ম্লান করার জন্যই কি তিনি ওই দলে এসে ঢুকেছেন?

এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল অনেক বছর পরে। বাংলাদেশের মসনদে তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতির বিশেষ মার্জনায় প্রধান জেল থেকে ছাড়া পেলেন। ছাড়া পেয়েই তিনি সোজা চলে গেলেন সর্বহারা দলের নিহত নেতা সিরাজ সিকদারের মাজার জিয়ারত করতে।

শফিউল আলম প্রধান কে? এবং কে? ছাত্রলীগে তাঁর অনুপ্রবেশ লক্ষ্য ছিল- আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোন্দল পাকিয়ে তোলা। আওয়ামী লীগকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়া।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।

বি.দ্র. পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ৮ আগস্ট।

আরও পড়ুন