• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০১৯, ০৪:৩৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৯, ২০১৯, ০৪:৪১ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (সাত)

দুর্ভিক্ষ ও বাসন্তী নাটকের মঞ্চায়ন

দুর্ভিক্ষ ও বাসন্তী নাটকের মঞ্চায়ন

চুয়াত্তরে পাক-মার্কিন সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলেপাড়ার এক হতদরিদ্র পরিবারের বাক্‌ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাসন্তীকে নিয়ে একটি ট্র্যাজেডি নাটকের মঞ্চায়ন করা হয়েছিল। এটা করেছিল ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কর্তৃত্বাধীন দৈনিক ইত্তেফাক। এটা সেই ‘ইত্তেফাক’, যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ইতিহাসে যাকে বাংলাদেশের নবজাগৃতির পুরোধা বলে উল্লেখ করা হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের প্রথম দিনেই এই পত্রিকার অফিস সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য পাক-মার্কিন চক্র নতুন আঙ্গিকে নানামুখী চক্রান্ত শুরু করে, তখন এই ষড়যন্ত্রে শামিল ছিল তৎকালীন বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের প্রভাবশালী একাংশ। পত্রিকাটি দুর্ভিক্ষের সন্ধানে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে রিপোর্টার শফিকুল কবির এবং ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদকে পাঠিয়েছিল রংপুরের কুড়িগ্রামে। আগে থেকেই সবকিছু নির্ধারিত ছিল। বিশেষ একটি নৌকায় বিশেষ একটি অঞ্চলে গিয়ে একটি হতদরিদ্র পরিবারের বাক্‌ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাসন্তীকে নগদ পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে রাজি করানো হয় একটি ফটোসেশনে। দরিদ্র বাসন্তী চকচকে পঞ্চাশ টাকার নোটটি পাবে, যদি একটি ছেঁড়া জাল সে পরিধান করে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। সেই সময়, ১৯৭৪ সালে, হতদরিদ্র বাসন্তীর কাছে পঞ্চাশটি টাকা ছিল স্বপ্নের মতো। বাসন্তী রাজি হয়েছিল। শফিকুল পঞ্চাশ টাকার নোটটি বাসন্তীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান আনছার আলী বেপারীর সংগৃহীত ছেঁড়া জালটি গায়ে জড়িয়ে কলার থোড় সংগ্রহ করছে অনাহারী বাসন্তী। তার পাশে দুর্গাতি নামের ছিন্ন জাল পরা আরেকটি মেয়ে। আফতাবের ক্যামেরা সেই পূর্বপরিকল্পিত সাজানো ছবিটি ধারণ করে। রংপুর মিশন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে ঢাকায় ফিরে আসেন ইত্তেফাকের রিপোর্টার শফিকুল আর ফটোগ্রাফার আফতাব। আফতাবের তোলা সেই ছবিগুলোর একটি ছাপা হয় ইত্তেফাকের প্রথম পাতায়। আমেরিকার বিশ্বস্ত অনুচররা সেটা ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় লিড ফটো হিসেবে ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি নষ্টের সূচনা করে। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে উৎখাতের প্রেক্ষাপটও তৈরি করে। দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই ছবি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর এক বছরের মাথায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

আফতাব আহমেদ
বাসন্তীর ছবি ধারণকারী সেই আলোকচিত্রী

আফতাব আহমেদ ছিলেন ইত্তেফাকের প্রধান আলোকচিত্র সাংবাদিক। বাড়ি রংপুর, পেশাগত কারণে পাকিস্তান আমল থেকেই খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরের অতি বিশ্বস্ত। স্বাধীনতার পর মোশতাক ঠাকুর চক্র তাকে কৌশলে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এক সময় আফতাব তাদের এতখানি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যাবতীয় আলোকচিত্র ধারণের জন্য একমাত্র তাকেই ঘাতকদের পক্ষ থেকে বাছাই করা হয়। ঘাতকদের দেওয়া সেই দায়িত্বটি তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেছিলেন। আফতাব-শফিকুল কবির পেশাগত কারণে আমার সহকর্মী ছিলেন। শফিকুল কবির একাত্তরে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং বাংলাদেশ বিরোধী কথিকার রচনাকারী ছিলেন। একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের ভূমিকার তালিকায় তার নাম এবং তার কথিকাটির নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। কাকতালীয়ভাবে হলেও এই দুজনই ২০১৩ সালে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এবং ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ও সময়ে। শফিকুল কবির ওই বছর ১৩ অক্টোবর দুপুরে জুরাইনের বাড়িতে বুকে ব্যাথা অনুভব করলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। আর ২৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর পশ্চিম রামপুরায় নিজ বাসায় খুন হন আফতাব আহমেদ। পরদিন সকালে তার হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চার তলার ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় আফতাব আহমেদ একাই বাস করতেন।

৯৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের একযুগ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের উপর তোলা বাসন্তীর ছবির জন্য আফতাব আহমদকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দেন এবং  ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার আফতাব আহমদকে একুশে পদক প্রদান করে। এর মাধ্যমে আফতাব আহমদের স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা প্রকাশ পায়। এরপর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্র শিবির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জামায়াতের তৎকালীন আমির, একাত্তরের আলবদর বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর হাত থেকে পদক গ্রহণের মধ্য দিয়ে আফতাবের জামাতি কানেকশনের বিষয়টি সবার কাছে স্পস্ট হয়।

জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ইসলাম ছাত্রশিবির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জামায়াত ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর হাত পুরষ্কার নিচ্ছেন বাসন্তীর ছবি ধারণকারী সেই আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদ-সংগৃহীত

এবার ফিরে যাই বাসন্তীর সেই ছবি প্রসঙ্গে। বাসন্তীর সেই ছবি তোলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন জনৈক রাজো বালা। সেই রাজো বালার বর্ণনা থেকে জানা যায়, ’৭৪-এ যখন বাসন্তী-দুর্গাতিদের ছবি তোলা হয়, তখন ছিল বর্ষাকাল। চারদিকে পানি আর পানি। এমনই প্রেক্ষাপটে তিনজন লোক আসেন বাসন্তীদের বাড়িতে। এদের মধ্যে একজন তৎকালীন স্থানীয় রিলিফ চেয়ারম্যান, তার নাম আনছার। অপর দুজনকে রাজো বালা চিনতে পারেননি। বাসন্তী-দুর্গাতিদেরকে একটি কলাগাছের ভেলায় করে বাড়ি থেকে বের করা হয়। আর অন্য একটি ভেলায় রেখে তাদের ছবি নেয়া হয়। এসময় পাশের একটি পাটক্ষেতে ছিলেন রাজো বালা। ছবি তোলার আগে দুই সাংবাদিক বাসন্তীদের মুখে কাঁচা পাটের ডগা দিয়ে বলে, এগুলো খেতে থাকো। এর বেশি আর কিছু জানাতে পারেননি রাজো বালা।

বাসন্তীর কাকা বুদুরাম দাশ এই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিকার চেয়েছিলেন। ছবি সম্পর্কে বুদুরাম দাশের ভাষ্য, ‘সঠিকভাবে দিন-তারিখ মনে নেই। একদিন বাসন্তী ও তার কাকাতো বোন দুর্গাতিসহ পরিবারের আরও কয়েকজন মিলে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধের ওপর বসে ছিলেন। তখন দুপুর গড়িয়েছে। এমন সময় ইউপি চেয়ারম্যান আনছার আলী বেপারী (একসময়ের মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতা) কয়েকজন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ একজন সাংবাদিককে (আফতাব আহমেদ, আলোকচিত্রী, দৈনিক ইত্তেফাক) নিয়ে আসেন জেলেপাড়ায়। তারা বাসন্তী ও দুর্গাতির ছবি তুলতে চান। এ সময় তারা বাঁধের ওপর জেলেদের রোদে শুকোতে দেয়া জাল তুলে এনে তা বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ির ওপর পরিয়ে ছবি তোলেন।’

বুদুরাম এভাবে ছবি তুলতে আপত্তি জানিয়ে নিষেধ করেছিলেন। তবুও তারা শোনেননি। এ প্রসঙ্গে বুদুরাম দাশ তার ভাষায় জানান, ‘চেয়ারম্যান সাব ছেঁড়া হউক আড় ফারা হউক একনাতো শাড়ি আছে উয়ার উপরত ফির জাল খান ক্যা পরান, ইয়ার মানে কী? (চেয়ারম্যান সাহেব। ছেঁড়া হোক একটা শাড়ি তো আছে, তার ওপর জাল কেন পরান; এর কারণ কী?)

তখন সাইবদের মইদ্যে একজন কয় ইয়ার পরোত আরো কত কিছু হইবে...’ (তখন একজন সাহেব জানায়, এরপর আরো অনেক কিছু হবে...)। (সূত্র : ‘চিলমারীর এক যুগ’ – মোনাজাত উদ্দিন)

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ এবং ‘বাসন্তী ও দুর্গাতি’ উপাখ্যান নিয়ে অনেক লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক কাজ করেছেন। তাদের একজন সাংবাদিক জাকির হোসেন। ২০০০ সালে তিনি কুড়িগ্রামে যান আনছার আলী বেপারী এবং বাসন্তীর সঙ্গে দেখা করতে। এই আনছার আলী বেপারী বাসন্তীর ছবি তুলতে সহযোগিতা করেছিলেন। চুয়াত্তরে আনছার আলী ছিলেন কুড়িগ্রামের রমনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সারা দেশের সকল ইউনিয়নে বিনা নির্বাচনে যাদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, আনসার আলী বেপারী ছিলেন তাদেরই একজন। পেশায় তিনি পাটের বেপারী। স্থানীয় বাজার থেকে পাট কিনে বিক্রি করতেন সিরাজগঞ্জসহ দেশের বড় বড় পাটের বাজারে। এলাকায় তিনি চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিত। আর বিশেষভাবে পরিচিত তিনি ‘বাসন্তী’র নায়ক হিসেবে।

শফিকুল কবির 
ইত্তেফাকের তৎকালীন রিপোর্টার। একাত্তরে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং বাংলাদেশ বিরোধী কথিকার রচনাকারী ছিলেন তিনি।

আনছার আলীর বাড়ির বৈঠকখানায় তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা হয় এই গবেষণাকর্মের অন্যতম সহযোগী সাংবাদিক জাকির হোসেনের। আলাপকালে আনছার আলী বলেন, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত ও কর্মী। আর এ কারণেই তাকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু সারা দেশের চেয়ারম্যানদের লঙ্গরখানা খোলার নির্দেশ দিলে আনছার আলীও তার বাড়ির পাশে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। ওই সময় ঢাকা থেকে হঠাৎ একদিন দুজন সাংবাদিক তার কাছে আসে। এই দুই সাংবাদিকের একজনের নাম আফতাব আহমেদ, আরেকজনের নাম তার মনে নেই। সাংবাদিক দুজন আনছার আলীকে জানান, বঙ্গবন্ধু তাদের পাঠিয়েছেন দরিদ্র মানুষের ছবি তোলার জন্য। এই ছবি দেশ-বিদেশের পত্রিকায় ছাপা হলে বিদেশ থেকে অনেক রিলিফ আসবে। দেশে কোনো অভাব থাকবে না। আর এই ছবি তোলার কাজে তিনি যদি সহযোগিতা করেন, তবে তার নামও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এ কথা বলেই আনছার আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেননা এই কাজের জন্য এখন তিনি ভীষণ অনুতপ্ত। কারণ তার নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা হয়নি। ওই কাজে সহযোগিতা করার জন্য এলাকার সকল মানুষের কাছে তিনি ঘৃণার পাত্র। বাসন্তীর কাহিনি তাকে ইতিহাসের পাতায় নায়ক নয়, খলনায়কে পরিণত করেছে।

বয়সের ভারে ন্যুজ আনছার আলী চোখ মুছে বিষণ্ন মনে, ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, ছবি তোলার জন্য তিনি ওই দুই সাংবাদিককে জেলেপাড়ায় নিয়ে যান। সেখানে দুই সাংবাদিক তাদের পরিকল্পনামাফিক ছবি তোলে। এর পরের কাহিনি তো সবারই জানা। তবে পত্রিকায় বাসন্তীর নামে জাল পরা যে ছবিটা ছাপা হয়েছে, সেটা বাসন্তীর ছবি ছিল না। ওই ছবিটি ছিল বাসন্তীর কাকাতো বোন দুর্গাতির। দুর্ভিক্ষের সময় দুর্গাতিরা সপরিবারে ভারতে চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুর্গাতি মারা যায়। তবে বাক্‌ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাসন্তী দুই সাংবাদিকের চক্রান্তের সাক্ষী হিসেবে আজও বেঁচে আছে। বেঁচে আছি আমিও। বাসন্তী এখন রৌমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের চরে অবস্থিত গুচ্ছগ্রামের একটি ঘরে বসবাস করে।

উল্লেখ্য, জাকির হোসেনের সঙ্গে আনছার আলীর আলাপচারিতার কয়েক মাস পর ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আনছার আলী মারা যান। আর বাসন্তী ব্রহ্মপুত্র নদের যে চরে বসবাস করত, সেই চরটিও এখন ভেঙে গেছে। বাসন্তী এখন ব্রহ্মপুত্রের তীরে জোরগাছ বাজারের কাছে বাস করে। উপজেলা প্রশাসন তাকে একটি ঘর তুলে দিয়েছে। তার আপন বলতে বেঁচে আছে একমাত্র ভাই। এই ভাইয়ের সহযোগিতা এবং বয়স্ক ভাতার সামান্য ক’টা টাকায় চলছে বাসন্তীর জীবন।

বাক্‌প্রতিবন্ধী বাসন্তীর জন্ম ১৯৪৬ সালে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার বজরা দিয়ারখাতা গ্রামের জেলে পরিবারে। ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত বজরা দিয়ারখাতা গ্রামের অভাবী জেলে পরিবারের নানান প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠে সে। এরপর বাসন্তী পরিবারসহ জেলে পরিবারগুলো ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের মুখে সবকিছু হারিয়ে আশ্রয় নেয় রমনা ইউনিয়নের খড়খড়িয়া গ্রামে। এখানে জেলে পরিবারগুলো ব্রহ্মপুত্র নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে বাসন্তীর বিয়ে হয় একই গ্রামের বাবুরামের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা চিলমারীতে আসার আগে স্বামী বাবুরাম বাক্‌প্রতিবন্ধী স্ত্রী বাসন্তীকে ছেড়ে একই এলাকার সাইব রানী নামের এক মহিলাকে বিয়ে করে ভারতের সুখচরে চলে যায়। এরপর বাসন্তীর বড় ভাই আশুরাম দাস, ছোট ভাই বিষুরাম দাসসহ জেলে পরিবারগুলো ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে চলে যায় মুক্তাঞ্চল রৌমারীতে। এদের মধ্যে অনেকেই ভারতে আত্মীয়-স্বজন, শরণার্থী শিবির ও মাইনকার চরে আশ্রয় নেয়। এভাবেই তারা যুদ্ধের ৯ মাস অতিবাহিত করে। দেশ স্বাধীনের পর বাসন্তীসহ জেলে পরিবারগুলো পুনরায় নিজ ভিটে-মাটিতে ফিরে আসে। কিন্তু যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে পাক সেনাদের তাণ্ডবলীলায় এই জেলেপল্লিটি সম্পূর্ণ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে থাকে। ভাইদের সঙ্গে বাসন্তী নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে এলেও তার স্বামী বাবুরাম আর ফিরে আসেনি। অসহায় বাসন্তীর দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে তার বড় ভাই আশুরাম ও ছোট ভাই বিষুরাম দাসের ওপর। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার জোরেশোরে কাজ শুরু করে। এর অংশ হিসেবে নিঃস্ব জেলে পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করতে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁবু, খাদ্যদ্রব্য, মাছ ধরার জাল, দড়ি ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এভাবেই চলছিল জেলে পরিবারের জীবনযাত্রা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ’৭৪-এ পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আর এই দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে এক নির্মম ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই মঞ্চস্থ হয় বাসন্তী নাটক।

লেখক ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

[ পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর ]

আরও পড়ুন