• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯, ০৪:২১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯, ০৪:২৫ পিএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (আট)

কেন নির্ধারিত হয়েছিল ১৫ই আগস্ট

কেন নির্ধারিত হয়েছিল ১৫ই আগস্ট

একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যার ‘ব্লুপ্রিন্ট’ ছিল অত্যন্ত পাকা হাতের তৈরি। অতিশয় কূটকৌশল ও ঘটনার আগে-পরে সবকিছু নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই হত্যা চক্রান্তের ব্ল‍ুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়। এটা যে শুধু খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, মেজর ফারুক, রশিদ, ডালিমদের মতো কতিপয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্ত‍ার সমষ্টি বা ফল নয়, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এটাও বোঝা যায় যে, এর পেছনে ছিল অনুরূপ রাজনৈতিক হত্যার অভিজ্ঞ পেশাদার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী গোষ্ঠী, যারা কিনা ইতিপূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বহু পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা তৈরি করে হাত পাকিয়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ ধরনের অনেক ‘নীলনকশা’ অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়িত করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতির কৌশলগত দিকসমূহ বিশেষভাবে মাথায় রেখে এই হত্যাকাণ্ডের ‌দিনক্ষণ নির্ধারণের মাধ্যমে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে ও প্ল্যানিং সেল গঠন করে।

এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করা যায়। একসময় ভিয়েতনামের দুই অংশ ছিল- দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও উত্তর ভিয়েতনাম। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ক্ষমতায় ছিলেন মার্কিনদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রেসিডেন্ট নোগো দিন দিয়েম। মার্কিনদের পৃষ্ঠপোষকতায় দিয়েম ১৯৫৫ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ১৯৬৩ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। মার্কিনরা যখন দেখল প্রেসিডেন্ট দিয়েমের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে না, তখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত ও হত্যা করে।

নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রেসিডেন্ট নোগো দিন দিয়েম

১৯৬৩ সালের ১ নভেম্বর এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল ডাঙ ভান মিন। পরের দিন (২ নভেম্বর) সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রেসিডেন্ট নোগো দিন দিয়েম এবং তার ছোট ভাই নোগো দিন নুহকে গ্রেফতারের পর নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রেসিডেন্ট দিয়েমের ছোট ভাই নুহ রাষ্ট্রীয় কোনো পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। কিন্তু রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সরকারের বিভিন্ন স্তরে তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। প্রেসিডেন্ট দিয়েম ছিলেন চিরকুমার। এ কারণে ছোট ভাই নুহ এবং তার স্ত্রী ট্র্যান লি জুয়ান প্রেসিডেন্টের সরকারি ভবনে দিয়েমের সঙ্গে বসবাস করতেন। ট্র্যান লি জুয়ানকে ভিয়েতনামের সবাই ম্যাডাম নুহ বলে সম্বোধন করতেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৫ সাল থেকে ৬৩ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ভিয়েতনামের ফার্স্ট লেডি। অভ্যুত্থানের সময় ম্যাডাম নুহ ভিয়েতনামে ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বেভার্লি হিলসে। সঙ্গে ছিল আঠারো বছর বয়সী কন্যা নোগো দিন লি থাই। অন্য সন্তানেরা ছিল ভিয়েতনামে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ম্যাডাম নুহ ধরে নিয়েছিলেন তার সন্তানেরা দায়েম ও নুহের পরিণতি বরণ করেছে। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের হত্যা না করে রোমে নির্বাসিত করে। পরে ম্যাডাম নুহ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রোমে আসেন। দিয়েম ও নুহ হত্যাকাণ্ডের পরই তিনি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে বলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার কোনো শত্রুর দরকার নেই। আমেরিকার উসকানি ও সহযোগিতা ছাড়া কোনো অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে পারে না।’ ("Whoever has the Americans as allies does not need enemies", and that "No coup can erupt without American incitement and backing".) ম্যাডাম নুহ এই অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট বিশ্বাসঘাতকেরা আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। আমি আপনাদের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামে হত্যার রাজনীতি শুরু হলো।”

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ম্যাডাম নূহ

ম্যাডাম নুহ বাইবেলের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “জুডাস মাত্র ৩০টি রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছিল। আর নোগোর ভাইয়েরা বিক্রি হয়েছে সামান্য কিছু ডলারের বিনিময়ে।” যখন ম্যাডাম নুহকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চান কি না, তখন তিনি বলেন, “আমি  এমন একটি দেশে থাকতে পারব না, যে দেশের সরকার পেছন থেকে আমার পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে। আমি বিশ্বাস করি যে জাহান্নামের সমস্ত শয়তান আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে।”

ম্যাডাম নূহ দীর্ঘ প্রায় চার দশক ইতালি ও ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। ৮৬ বছর বয়সে ২০১১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে রোমের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। তিন সপ্তাহ পর ২৪ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করতে পাক-মার্কিন চক্রান্তকারী গোষ্ঠী ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় ভারতের জাতীয় দিবসকে। এই দিনটিকে সামনে রেখে তারা রক্ষীবাহিনীকে নেতৃত্বশূন্য করে এবং অন্যান্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে যেন বড় ধরনের কোনো গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি না হয়, এ বিষয়টিকেও তারা নীলনকশায় অন্তর্ভুক্ত করে। খুনিচক্র পঁচাত্তরের ১ সেপ্টেম্বরের আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ১ সেপ্টেম্বর নির্দিষ্ট সীমার আগে দিনক্ষণ ঠিক করা হয় পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট, শুক্রবার। কেননা ১ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হওয়ার কথা ছিল কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) প্রশাসন। এটা চালুর পর সেনাবাহিনীকে ব্যারাক থেকে বের করে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দেয়া হবে। ওই ৬৪ জেলায় সেনা ইউনিটের ওপর থাকবেন ৬৪ জন গভর্নর। তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মিলিটারি অ্যাকশন নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ সেনারা তখন জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে হাতিয়ার ছেড়ে কৃষি উৎপাদনে যোগ দেবে।

সিইআইয়ের মাথাব্যাথা ছিল রক্ষীবাহিনী 
সিআইএ এবং খন্দকার মোশতাক চক্রের একটি বড় মাথাব্যাথা ছিল রক্ষীবাহিনী। রক্ষীবাহিনী ছিল বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার ছক তৈরিতে চক্রান্তকারীরা রক্ষীবাহিনীর উপর বিশেষভাবে নজর দেয়। নানাভাবে রক্ষীবাহিনীকে জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীকে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করে এবং রক্ষীবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য নানামুখী চক্রান্ত শুরু করে। রক্ষীবাহিনীর প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জ‍ামানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি কোর্সের প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নূরুজ্জামান সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আর তৎক্ষণাৎ গুজব রটানো হয় রক্ষীবাহিনীর জন্য ট্যাংক যোগাড় করতে বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামান বিদেশ যাচ্ছেন। বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ১২ আগস্ট রওনা হন। এ সময় রক্ষীবাহিনীর তত্ত্বাবধানের ভার ছিল বঙ্গবন্ধুর মুখ্যসচিব রুহুল কুদ্দুসের উপর। কিন্তু কুদ্দুস সাহেবও তখন লন্ডনে। ফলে রক্ষীবাহিনীর অবস্থা তখন অনেকটা কাণ্ডারীহীন নৌকার মতো। এ অবস্থায় ঐ বাহিনী যে ঘাতকদের ট্যাংকবাহিনীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, এ বিষয় চক্রান্তকারীরা ছিল নিশ্চিত। না থাকুক সেই ট্যাংকে কোনো গোলা। সেটা তো অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার। রক্ষীদের সেটা জানার কথা নয়। তাই চক্রান্তকারীরা ধরেই নিয়েছিল, রক্ষীবাহিনীর শিবিরে ট্যাংকের উপস্থিতিতে রক্ষীদের হাতের রাইফেল খসে পড়বে।

বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে লন্ডনে জানলেন বঙ্গবন্ধু নিহত। তখন তার কিছুই করার ছিল না। সিআইএ যে রক্ষীবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ১৫ই আগস্টের আগে বাহিনীর প্রধানকে আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এটা এখন অত্যন্ত পরিষ্কার।   

ফারুকের গল্প ও আসল সত্য!
বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনটি ছিল শুক্রবার। এই শুক্রবার নিয়ে মেজর ফারুক বেশ একটা গল্প ফেঁদেছিল। এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল, শুক্রবার ভোরের আজানের সময় তার জন্ম । আবার এই শুক্রবার তার সাদির দিন। এমনই একটি শুক্রবারেই সে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ছেড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। অন্যদিকে দিয়ে এই শুক্রবার মুসলমানদের কাছে পরম পবিত্র দিন। তাই এই হত্যার কাজটি করার জন্য তারা শুক্রবারকেই বেছে নেয়!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

কিন্তু আসল ব্যাপর কি তাই?  নিশ্চয়ই তা নয়। এর অন্য কারণ আছে। পঁচাত্তরে ১৫ আগস্ট পড়েছিল শুক্রবার। আর এই ১৫ আগস্ট হল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। চক্রান্তকারীদের আশঙ্কা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে, পঁচিশ বছরের ভারত-বাংলাদেশ শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী ভারত এ ব্যাপারে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। ভারত সামরিক অভিযান চালালে তা সামাল দেয়া তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের সরকার, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী ব্যস্ত থাকবে। এমন একটি দিনে তারা প্রতিবেশী একটি দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তাই এই দিনটিকেই চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়। 

নেতৃত্ব শূন্য ছিল তৃণমূল 
পঁচাত্তরের আগস্ট মাসে নবগঠিত বাকশালের (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) জেলাওয়ারি কর্মকর্তা নিয়োগের প্রাক্কালে ৬৪ জেলার ৬৪ জন নবনিযুক্ত গভর্নরের ট্রেনিং চলছিল। তাই চক্রান্তকারীরা ধরেই নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় কারফিউ জারি করে তাঁদের আটক করতে পারলে সারা বাংলায় কোথাও কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠবে না। নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন জেলার বাকশাল তখন ছিল কাণ্ডারীহীন নৌকোর মতো। 

মোশতাকের কৌশলী মিথ্যাচার
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্টের গদিতে বসেই এক ঘোষণায় বাকশাল কর্মীদের মনে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করে। সে থানায় থানায় নির্দেশ পাঠায় যে, আওয়ামী লীগ (বাকশাল নামটি তিনি উচ্চরণ করেননি) নেতা ও কর্মীদের ধনসম্পদ ও জীবনের উপর যেন কোনো রকম আঘাত না আসে। তার মন্ত্রিসভায়ও দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর আমলেরই সব পুরনো মুখ। এতে অনেকে তাই ধরে নিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি বাকশালের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলশ্রুতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবতকে হত্যা করে চক্রান্তকারীরা জনমনে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছিল যে, বাকশালের একটি অংশ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকট আত্মীয়দের সরিয়ে দিয়েছে। 

জিয়া নিয়েছিল সেনা বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব
ঘাতকচক্র সৈন্যবাহিনীর কাছ থেকে খুব একটা বিপদের আশঙ্কা করেনি। কেননা সে‍নাবাহিনীর তৎকালীন ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই করে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এই হত্যার প্রতিবাদে সৈন্যবাহিনীর বৃহত্তর অংশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে জিয়া তাঁদের সামাল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং দায়িত্ব নেয়। জিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- ঘাতকদের সে রক্ষা করবে এবং তাদের উপর সেনাবাহিনীর কাউকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেবে না। এমতাবস্থায় সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে ঘরে আটক রাখতে পারলে, ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানই হবেন সর্বেসর্বা। তখন তার আদেশ অমান্য করে কেউই কামান, বন্দুক নিয়ে মাঠে নামতে পারবে না। 

জিয়াউর রহমান

চায়ের বদলে এসেছিল প্রাণঘাতী ট্যাংক
বাংলাদেশের ট্যাংকবাহিনী সম্পর্কে কিছু কথা প্রয়োজন। কেননা এখনো অনেকেই প্রায়শই এই প্রশ্ন তোলেন যে, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ যখন নানা সমস্যার ধুঁকছে, তখন বাংলাদেশের সেনাশিবিরে একটি ট্যাংকবাহিনী যোগ করতে বঙ্গবন্ধুর হঠাৎ মাথাব্যথা হল কেন? বাংলাদেশে তিনি তো তেমনি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার পক্ষে ছিল না। শক্তিশালী সেনাবাহিনীর গঠনের বিরোধী বঙ্গবন্ধু হঠাৎ ট্যাংক বহর গড়ে তুলেছিলেন এ কারণে যে, ট্যাংকগুলো পাওয়া গিয়েছিল উপঢৌকন হিসেবে।

১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতার স্মারক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেখানে কিছু একটা পাঠানো উচিত বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু কী পাঠাবেন তিনি!  অস্ত্র! নাকি অর্থ! এর দু’দিক থেকেই যে বাংলাদেশ দুর্বল। ঠিক হল, যুদ্ধরত আরবদের জন্য বাংলাদেশ পাঠাবে নিজের বাগানের উন্নত মানের চা। সত্যি সত্যি ওই বছর ২৭ অক্টোবর ঢাকা থেকে এক বিমান চা পাঠানো হয় কায়ারোতে। বঙ্গবন্ধুর এই অভাবনীয় উপহার পেয়ে খুশি হন মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। যুদ্ধ শেষে প্রেসিডেন্ট সাদাত ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুকে ৩০টি ট্যাঙ্ক উপহার দেয়ার প্রস্তাব পাঠান। প্রেসিডেন্ট সাদাতের এই প্রস্তাবে কোনো উৎসাহ বোধ করেননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পররাষ্ট্র দফতর, বিশেষভাবে মন্ত্রিসভার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট সাদাতের প্রস্তাবে অসম্মতি জানাননি। তখন কে জানত মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই এই সব ট্যাংক ব্ঙ্গবন্ধুর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে। এইসব ট্যাংক সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর প্রতি মাসে দুদিন করে মহড়া হতো। চক্রান্ত শিবিরের দুই ভায়রা ফারুক ও রশিদ প্রতি মাসে দু’রাতে যুক্ত মহড়ার ছাড়পত্র পায়। পঁচাত্তরের আগস্ট মাসের মহড়ার দিনটি ছিল ১৪ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী রাত ১২টার পরই ১৫ আগস্ট, শুক্রবার। বঙ্গবন্ধু হত্যার তারিখ নির্বাচনের ব্যাপারে চক্রান্তকারীরা নিশ্চয়ই ওই দিনটির কথা মাথায় রেখেছিল।

ট্যাংকের গোলা ছিল গাজীপুরে 
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থ‍া রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং বা ‘র’-এর তৎকালীন পরিচালক রামেশ্বর নাথ কাও ঢাকা সফরে এলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘ভারতে কি এমন কোনো অস্ত্র আছে যা দিয়ে এই সব ট্যাংককে অতি সহজে বিকল করে ফেলা যায়!’ এই তথ্যটি ভারতীয় সাংবাদিক পরেশ সাহাকে জানিয়েছিলেন ‘র’-এর একজন প্রবীণ বাঙালি অফিসার। রামেশ্বর নাথ কাও যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখন ওই বাঙালি অফিসার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কোনো কোনো সময় তিনি দোভাষীর কাজও করেছেন। রামেশ্বর নাথ কাও নাকি হেসে বলেছিলেন, ওইসব ট্যাংকের গোলা যদি ট্যাংক বাহিনীর অফিসারদের কাছে না থাকে তাহলেই তো ঐসব ট্যাংক অকেজো। ট্যাংকগুলোকে নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। 

এসব ট্যাংক সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর প্রতি মাসে দুদিন করে মহড়া হতো ঠিকই, কিন্তু ট্যাংকের গোলা কোনো সময়ই ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসারের কাছে থাকত না। থাকত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দূরে, জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে। এ বিষয়ে খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো। খুব কম লোকেরই এ তথ্য জানা ছিল। এ সত্ত্বেও এই ট্যাংক বাহিনী বঙ্গবন্ধু হত্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। 

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অপরিসীম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আরবদের প্রতি আন্তরিকতা দেখিয়েছিলেন। অথচ ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম চক্রী জেনারেল জিয়া যখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং যেদিন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, কমিউনিস্ট পার্টি ও ডেমোক্রেটিক লীগকে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য নিষিদ্ধ করে, ওই দিনই জেনারেল জিয়া বিদেশ থেকে একটি অভিনন্দন বার্তা পান। দেশে সেনাবিদ্রোহ দমনে সফল হওয়ার জন্য জেনারেল জিয়াকে এই অভিনন্দন জানান মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত...

জেনারেল জিয়া ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার খুনি। সিরিয়াল কিলার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে গঠিত প্ল্যানিং সেলের অন্যতম সদস্য ছিলেন এই জিয়া। ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত তার গঠিত সামরিক আদালতের নামে প্রহসনের বিচারে যে ১,১৪৩ জন সৈনিক ও অফিসারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়, তাদের দীর্ঘশ্বাসই পুঞ্জিভূত হয়েছিল চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে। সেখানে জিয়াকে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করতে হয়। 

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

[ বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর, বুধবার। সেই সঙ্গে এখন থেকে এই ধারাবাহিকটি প্রতি বুধবার প্রকাশ হবে। ] 

আরও পড়ুন