জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার ড. আবদুর রাজ্জাক অবশেষে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি দুটি বিষয় সামনে এনেছেন। এর একটি হচ্ছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত তাদের সংঘটিত অপরাধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য ভুল স্বীকার করে এদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করা । আরেকটি হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আলোকে জামায়াত নেতাদের নিজেদের সংস্কার করতে না পারা।
এই দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে এ রাজনীতির সঙ্গে আর যুক্ত না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। আসলে স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামের ভেতরে একটি নতুন ভাবনা উঠে এসেছে। তারা নিজেদের নতুনভাবে গোছাতে চায় এবং ভিন্ন আদলে তাদের চেহারা তুলে ধরতে চায়। সম্ভবত গত ছয় বছরে লন্ডনে প্রবাসী আবদুর রাজ্জাক অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, সাবেকী কাঠামোয় জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আর এগোনো যাবে না। এজন্যই তিনি এতদিন পর জামায়াত থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ড. আবদুর রাজ্জাক যে অত্যন্ত অমায়িক এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আবার পেশাগত জীবনেও তিনি যে অত্যন্ত মেধাবী আইনজীবী এ বিষয়টিও প্রশ্নাতীত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মামলায় জামায়াতের পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ার ৫ দিনের মাথায় দেশত্যাগ করেন। এর পেছনে কারণ আছে বৈকি! আমরা যতদূর জানি, বিগত ৬ বছরের প্রবাস জীবনে ড. রাজ্জাক আন্তর্জাতিকভাবে জামায়াতের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জামায়াতের পক্ষে লবিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এতদিন পরে রাজ্জাক সাহেবের যে বোধোদয় হলো এর জন্য তাকে সাধুবাদ জানিয়ে এটুকু বলা যায়, এটা কি তার চৈতন্যোদয়, না কি এটা জামায়াতের সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী রাজনীতির নতুন কৌশলের অন্তর্গত। জামায়াত থেকে এভাবে বার বার সরে যাওয়া মানুষের চেহারাগুলো আমাদের কাছে বেশ স্পষ্ট। বিভিন্ন সময় তারা জামায়াত থেকে সরে গিয়ে ভিন্নভাবে একই আদর্শ অনুসরণ করেছে। রাজ্জাক সাহেবও হয়তো এই চিন্তা থেকেই পদত্যাগ করেছেন। তিনি এখন গণতান্ত্রিক আদলে জামায়াতকে নতুন করে সংগঠিত করতে চান। তবে এমন সময় ড. রাজ্জাক তার সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করলেন যখন সংসদে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতের বিরুদ্ধে চলমান মামলাটি দ্রুত ফয়সালার মাধ্যমে জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক স্পষ্টতই বলেছেন যে, জামায়াতের ব্যাপারটি যত দ্রুত শেষ করা যায় সেই চেষ্টা চলছে। বিষয়টি লক্ষ করলে আমরা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে পারব। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য, ব্যারিস্টার রাজ্জাক প্রথম থেকে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, ৩০ বছর ধরে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন- একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াত যেন দুঃখ প্রকাশ করে। এটাকে যদি আমরা তার সত্যভাষণ হিসেবে ধরে নিই তাহলে সহজেই বলা যায়, জামায়াতের কাঠামো তিনি জানেন এবং বোঝেন। সেহেতু তিনি অনেক আগেই পদত্যাগ করতে পারতেন, তাহলে কেন করলেন না! দ্বিতীয়ত, তিনি জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এ দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন কেন! তৃতীয়ত, যখনই জামায়াতের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়গুলো বার বার সামনে এসেছে তখন তিনি তার নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করার সুযোগটি হারিয়েছেন, কিংবা তিনি তা গ্রহণ করেননি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, ড. রাজ্জাক নতুন করে নেতৃত্ব গ্রহণ করার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার চেষ্টা করছেন!
আমরা যদি জামায়াতের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, সেই সত্তরের দশকে জামায়াতের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা যখন সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন জামায়াত একবার বিভক্ত হয়েছিল। তখন প্রকাশ্যে রাজনীতি করার কোনো অধিকার জামায়াতের ছিল না। কেননা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি করার অধিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। ’৭৫-এ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে সম্পূর্ণভাবে আত্মস্থ করে সেই সময় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। সে সময় জামায়াত ভিন্ন নামে অর্থাৎ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের (আইডিএল) ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। জামায়াতের আদর্শের ঢাল হিসেবে তখন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ কাজ করে। কারণ জামায়াত সরাসরি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখেছি, আইডিএল অকার্যকর হয়েছে এবং জামায়াত শক্তিশালী হয়েছে। এর মাধ্যমে আদর্শগতভাবে যখন জামায়াতের রাজনীতি করার ও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ সুস্পষ্ট হয়েছে তখন আইডিএল-এর প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে। অর্থাৎ চেহারা বদলে জামায়াত আসল চেহারায় ফেরত এসেছে। এখন আমরা যদি ধরে নিই, জামায়াতের নাম না দিয়ে নতুন আরেকটা আইডিএল-এর জন্ম দেয়ার জন্য এবং নতুন বোতলে সেই পুরনো মদ ঢালার জন্য ড. রাজ্জাক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তাহলে সেটা আমাদের কাছে খুব একটা বিস্ময়ের ব্যাপার বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতির ধর্মটাকে সম্পূর্ণভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা যখন নস্যাৎ হওয়ার উপক্রম হয়েছে সেই সময় এটাকে যদি আবার স্যালাইন দিয়ে কিংবা কোরামিন দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো নিশ্চুপ থাকবে বলে মনে হয় না।
আমরা আরেকটি বিষয় খুব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, কোনো না কোনোভাবে জামায়াতকে রাজনীতিতে আনার জন্য কোনো কোনো মহল নানাভাবে সক্রিয়। জামায়াত এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনার ভেতর দিয়ে যে রাজনীতি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রবেশ করে, জঙ্গিবাদ কিংবা জঙ্গি আদর্শের গোপন প্রচার সম্পন্ন করে, তাদের ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। আমরা মনে করি না বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এই ধরনের দেউলিয়াপনার প্রয়োজন আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বার বার একটি কথাই স্পষ্ট করেছেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ কথা বলেছেন যে, বাংলাদেশে যদি রাজনীতি থাকতে হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রাজনীতিই থাকতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিরোধী দলও কামনা করি। মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের সুকৌশলে আশ্রয় দেয়ার জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি না। আমি মনে করি, জামায়াত এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত এবং যে চার মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে, এই নীতিকে আমাদের চোখের সামনে রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের আরো খুঁজে দেখতে হবে, ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণকারী রাজ্জাক সাহেব ১৯৭১ সালে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন, একাত্তরে তার দর্শন কী ছিল, তার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কার্যক্রম কী ছিল। এ বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। এসব কিছু বিবেচনার মধ্যে রেখেই কিন্তু ড. রাজ্জাকের রাজনৈতিক অবস্থানের দিকে আমরা গভীরভাবে লক্ষ রাখব।
আমরা একজন মানুষকে পরিত্যাগ করতে চাই না, যদি তার ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আস্থা, আনুগত্য সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত থাকে এবং প্রকাশিত থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো রকম ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়া হলে মুক্তবুদ্ধির মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তা গ্রহণ করবে না। আমি বিশ্বাস করি, ড. রাজ্জাক যদি তার ভূমিকা ও দুঃখ প্রকাশের বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বলেন এবং এর পাশাপাশি যদি একাত্তরে পাকিস্তানিদের গণহত্যার নিন্দা করেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেন, জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন এবং পরবর্তীকালে ধর্মীয় কারণে ও ধর্মের নামে যত মানুষ হত্যা করা হয়েছে তার জন্য যদি ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তবে নিশ্চয়ই বর্তমান প্রজন্ম তার ব্যাপারে পুরোপুরিভাবে বিবেচনা করবে। শুধুমাত্র তার মুখের কথায় নয়, তার অবস্থানকেও সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট করতে হবে। এর ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ড. আবদুর রাজ্জাককে ক্ষমা করবে কি করবে না তখনই বিবেচনা করবে।
আবেদ খান : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ