“ভালো আছি কি না কইতে পারুম না, তয় বাঁইচা আছি। অপেক্ষা করি কবে দেখতে আইবো। ওগো সময় কই এত দূর দেখতে আইবো আমারে!” কথাগুলো ৭২ বছর বয়সী রাহেলা খাতুনের। ৫ সন্তানের জননী তিনি। বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। এখন তার ঠিকানা গাজীপুরের এক বৃদ্ধাশ্রমে।
আট বছর আগে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান তার সন্তানরা। পরিবার আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছেলেমেয়েরা, সময় করে দেখাও করতে আসেন না। অশ্রুসিক্ত চোখে এভাবেই অভিযোগ করলেন রাহেলা খাতুন।
এমন অভিযোগ শুধু তার একার নয়, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা শত শত মা-বাবার। জন্মদাত্রী মাকে কিছুদিন পর বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে যাবেন, এমন শর্তেও রেখে গেছেন অনেক সন্তান। দিন, বছর কেটে যায়, অপেক্ষার সময়ও শেষ হয় না বৃদ্ধ মা-বাবাদের।
‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র বশিয়া, কুড়িবাড়ী, মনিপুর-গাজীপুর’ বৃদ্ধাশ্রমটির পরিবেশ বেশ সুন্দর। সবুজে ঘেরা, শেওলা ধরা সরু রাস্তা, বকুল ফুলের ঘ্রাণে ভরে আছে চারপাশ। নিস্তব্ধ পরিবেশ, শত শত হলুদ কুমড়ো ফুল ফুটে আছে। একতলাবিশিষ্ট আধা পাকা ঘর, খোলা বারান্দা।
খোলা বারান্দায় পায়চারি করছেন কেউ কেউ। কেউ কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করছেন, কেউ আবার গীতা পাঠ করছেন। বারান্দায় বসে কয়েকজন আবার নিভৃতে তাকিয়ে রয়েছেন খোলা আকাশের দিকে। সব মিলিয়ে কেমন যেন এক হাহাকার। চোখে চোখ পড়তেই মনে হচ্ছে, কত না বলা কথা, কত অভিযোগ জমে আছে ওই দৃষ্টিগুলোতে।
পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না করেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা।
বিশ্ব মা দিবস আজ। করোনা এই সময়টাতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিঘ্ন সবাই। বৃদ্ধাশ্রমেও একই চিত্র। জীবনের শেষ প্রহর পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চাইলেও সেই অবকাশ নেই। পরিস্থিতির নির্মম বাস্তবতায় শেষ ঠিকানায়ই এই বৃদ্ধাশ্রম।
যে মা অক্লান্ত পরিশ্রম, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে হাজারো ব্যস্ততায় আগলে রেখেছেন সন্তানদের। সেই সন্তানদেরই এখন সময় নেই মাকে যত্ন করার কিংবা হাসিমুখে একটু কথা বলার।
নিশ্বাস ফুরিয়ে গেলে নিজ ভিটায় ফিরতে পারবেন কি না, তা-ও প্রায় অনিশ্চিত। পরিবার থেকে কেউ না এলে মৃত্যুর পরও এখানেই ঠিকানা হবে অসহায় এই মায়েদের।
৬৫ বছর বয়সী নাজমা বেগম। অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়েছেন। সংসারে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এখন অসহায় তিনি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। মেয়ের সংসারে থাকার মতো পরিস্থিতিও নেই। কেননা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কেউ তা গ্রহণ করবে না। এমন পরিস্থিতিতে মেয়ে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান। প্রায় ৬ বছর আগের কথা। সে থেকে এখানেই মুখ বুজে পড়ে আছেন।
৫ নম্বর কক্ষে থাকেন জোবাইদা বেগম। ৩০ বছর আগে মারা গেছেন স্বামী। দুই ছেলেকে বড় করেছেন অনেক কষ্টে। নিজে উপার্জন করেছেন। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এখন একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, অন্যজন থাকেন মালয়েশিয়া। দুই ছেলের কোনো এক পরিবারেও তার ঠাঁই হয়নি। জীবনের শেষ সময়টা বৃদ্ধাশ্রমেই কাটাচ্ছেন।
প্রত্যেক মানুষ নিজের মধ্যে ভীষণ একা। কখনো কী এমন নিঃসঙ্গতা মানুষের ঠিকানা হতে পারে! ভাবতেই অবাক লাগে, পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন যেই মা, যেই মা কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার শেষ ঠিকানা কি বৃদ্ধাশ্রম!