জার্মান লেখক এমিল এরিশকেস্টনার (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ -২৯ জুলাই ১৯৭৪) ছিলেন একাধারে লেখক, কবি, চিত্রনাট্যকার ও ব্যঙ্গলেখক। কবিতায় রসবোধ সঞ্চার ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়কে চমকের সাথে উপস্থাপনের জন্য তিনি খ্যাতি লাভ করেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তাঁর লেখা ‘এমিল ও গোয়েন্দাবাহিনী’ বইটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। বাংলাদেশে তাঁর এই বই থেকেই একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৬০ সালে কেস্টনার বাচ্চাদের জন্য লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন পদক পান। এ ছাড়া তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য চারবার মনোনীত হয়েছিলেন। এখানে প্রকাশিত তাঁর ‘সৌভাগ্যের উপকথা’গল্পটি সরাসরি জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মাফীজ দীন সেখ।
বয়স বেশি না হলেও সত্তর হবে বৃদ্ধ লোকটির। ধূম্রাচ্ছন্ন পানশালায় আমার মুখোমুখি বসেছিলেন তিনি। ওর চুলের ঝুঁটি এমন দেখাচ্ছিল যেন বরফপাত হয়েছে তার ওপর এবং চোখজোড়া জ্বলছিল স্কেটিং-রিংয়ের মতো।
“ইস্ মানুষরা কেমন যে বোকা,” লোকটি বললেন এবং মাথা নাড়লেন, এমনভাবে যে আমি ভাবলাম, ওর চুল থেকে বরফ ফলক উত্থিত হবে। “তবে হ্যাঁ, ভাগ্য কিন্তু অবশেষে কোনো অফুরন্ত সসিজ নয়, যা থেকে মানুষ প্রতিদিন তার প্রয়োজনীয় ফালিখানা কেটে নিতে পারে।”
“তা ঠিক,” মন্তব্য করলাম আমি। “ভাগ্য জিনিসটা অবশ্যই ভাজা খাবারের মতো মজাদার কিছু নয়। যদিও….”
“যদিও মানে?”
“যদিও ঠিক আপনাকে যেমন দেখাচ্ছে, যেন আপনার ঘরে ভাগ্যের ফালিখানা আগুনের ওপর বেশ লোভনীয়ভাবে সেঁকা হচ্ছে।”
“আমি একটা ব্যতিক্রম,” বললেন লোকটি এবং এক চুমুক পান করলেন। “ব্যতিক্রমটি হচ্ছি আমি। আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যার একটি বাসনা মুক্ত রয়েছে।”
নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি, তারপর কাহিনিটি বর্ণনা করে চললেন।
“সে বহুদিন আগের কথা,” শুরু করলেন তিনি এবং তার মাথাটি দুহাতের ওপর স্থাপন করলেন। “অনেক অনেক দিন আগের কথা। চল্লিশ বছর। আমি তখন ছোট এবং জীবনটা বিশ্রীরকম জীর্ণদশায় পরিপূর্ণ। একদিন দুপুরবেলা বড় বিষণ্ণমুখে সবুজ পার্কে একটা বেঞ্চেতে বসে আছি, এমন সময় আমার পাশে একজন বৃদ্ধলোক এসে বসলেন এবং কথায় কথায় বললেন, ‘বেশ। আমরা বিষয়টি ভেবে দেখছি। তোমার কাছে তিনটি বাসনা মুক্ত রয়েছে।’
আমি খবরের কাগজে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রইলাম, যেন কিছুই শুনতে পাইনি।
‘তোমার যা ইচ্ছা করে তাই চাও,’ বলতে লাগলেন লোকটি, ‘সুন্দরতম নারী, সর্বাধিক অর্থ অথবা সর্ববৃহৎ গুম্ফ- সে তোমার ব্যাপার। তবে শেষটায় ভাগ্যবান হবে তুমি। তোমার অসন্তোষ আমাদের আর সহ্য হয় না।’
লোকটিকে এমন দেখাচ্ছিল যেন সিভিল পোশাকে সান্তা ক্লজ। সাদা পুরু লম্বা দাড়ি, লাল আপেলের মতো গাল, ক্রিসমাস-চারাতে সুশোভিত তুলোর পাঁজের মতো ভ্রুযুগল। বালখিল্যতার কিছু নেই ওর মাঝে। হয়তো একটু বেশি শান্তশিষ্ট। লোকটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি আবার আমার খবরের কাগজে দৃষ্টি নিবন্ধ করলাম।
‘তোমার তিনটি বাসনা নিয়ে তুমি কী করবে, যদিও তা আমাদের ভাববার বিষয় নয়,’ বলে চললেন তিনি, ‘তবু খারাপ হতো না, যদি তুমি বিষয়টি আগেভাগে ভালোভাবে চিন্তা করে নিতে। কেননা তিনটি বাসনা, চারটেও নয়, পাঁচটাও নয়, শুধু তিনটিই মাত্র। এবং এরপর যদি তোমার আফসোস হয়, যদি তুমি অসুখীই থেকে যাও তবে আমরা না তোমার, না আমাদের নিজেদের সাহায্যে আসতে পারব।’
“জানি না আপনি নিজেকে আমার ওই অবস্থানে ভাবতে পারবেন কি না। একখানা বেঞ্চের ওপর বসা ছিলাম আমি এবং ঈশ্বর ও পৃথিবীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলাম। দূরে ট্রামের ঘণ্টা বাজছিল। বিচিত্র ভঙ্গিতে প্যারেড প্রাসাদের দিকে কোথাও চলে যাচ্ছিল। আর তখন আমার পাশে বসা সেই বৃদ্ধ বখাটে।”
“রাগে ফেটে পড়ছিলেন বুঝি আপনি?”
“ভীষণ রাগ হচ্ছিল। আমার অবস্থা তখন এমন—যেন উথলে পড়ার পূর্বমূহূর্তে একটা ফুটন্ত কেটলি। তারপর লোকটি তার শুভ্র পাঁজ আঁটা দাদুমার্কা মুখখানা পুনরায় খুলতে চাইলে রোষে কাঁপতে কাঁপতে বললাম আমি, ‘হে বুড়ো গর্দভ, আপনি যেন আমাকে আর তুই-তুমি বলে সম্বোধন না করেন, সে জন্য আমার খুশিমতো আমি আমার প্রথম, আমার অন্তঃস্থিত বাসনাটি প্রকাশ করছি—জাহান্নামের পথে কেটে পড়ুন আপনি এক্ষুনি।’ কথাগুলো সুন্দর মার্জিত ছিল না। কিন্তু এর চেয়ে অন্য কিছু পারছিলাম না আমি। অন্যথায় আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম।”
“তারপর?”
“তারপর আবার কী?”
“লোকটি কি চলে গেলেন?”
“ও, আচ্ছা। অবশ্যই চলে গেলেন তিনি। যেন হাওয়ায় মিশে গেলেন। একদম সেই মুহূর্তেই শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। এমনকি বেঞ্চের নিচে পর্যন্ত দেখে নিলাম আমি। তিনি সেখানেও আর নেই। একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে যাই আমি, ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার। নিজের কাছে তিন বাসনার ব্যাপারটি সত্য বলে মনে হতে লাগল তখন। এভাবে প্রথম বাসনাটি পূরণই হয়ে গেল। হা ঈশ্বর! আর তা যদি পূরণই হয়ে থাকে তবে সেই ভালো। প্রিয় সুবোধ দাদু, তা তিনি যেই হোন না কেন, শুধু চলেই গেলেন না, আমার পাশ থেকে বিলীনই হলেন না, ততক্ষণে তিনি চলে গেছেন শয়তানের আখড়ায়, গেছেন জাহান্নামে। ‘এমন তুচ্ছ খেয়ালিপনা করো না,’ নিজেকে বললাম আমি। ‘জাহান্নাম বলে কিছুই নেই, আর শয়তান, তা-ও নেই।’
“তবে সেই তিনটি বাসনা, তা ছিল নাকি! তবু, আমি ইচ্ছে করেছি কি করিনি, হাওয়ায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল… আমি শিউরে উঠলাম। আমার দু’হাঁটু কাঁপতে লাগল। অনেক কাঁপতে লাগল। কী করা উচিত আমার? বৃদ্ধকে আবার আসতে হবে, তা জাহান্নাম বলে কিছু থাক, বা না থাক। আমার কাছে এটি তার পাওনা। আমার দ্বিতীয় বাসনাটিকে কাজে লাগাতে হবে। তিনটির দ্বিতীয়টি, উহ। আমি কি যে বোকা! নাকি আমার এখন উচিত হবে, উনি এখন যেখানে আছেন সেখানেই থাকতে দেওয়া? সেই সুন্দর লাল, সেদ্ধ আপেলের মতো গালবিশিষ্ট লোকটিকে? ‘সেদ্ধ আপেলের মতো গাল,’ রোমাঞ্চিত মনে মনে ভাবতে লাগলাম আমি। আর কোনো উপায়ই ছিল না আমার। আমি চোখ দু’টি মুদিত করলাম এবং ভয়ে ভয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, ‘আমি ইচ্ছা করছি যে সেই বৃদ্ধ লোকটি আবার আমার পাশে এসে বসুন।’
“আপনি জানেন, বছর বছর ধরে, এমনকি স্বপ্নের মাঝে নিজের কাছে আমি মর্মভেদী অভিযোগ করে চলেছি যে আমি আমার দ্বিতীয় বাসনাটি অমনভাবে অপচয় করেছি। কিন্তু আমার তখন অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না…”
“তারপর?”
“তারপর আবার কী?”
“তিনি কি আবার এসে উপস্থিত হলেন?”
“ও, হ্যাঁ। অবশ্যই তিনি এলেন আবার। পরমুহূর্তেই। তিনি আমার পাশেই বসেছিলেন, যেন কখনোই যেতে বলিনি তাকে। অর্থাৎ তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি… যেন তিনি কোনো একটা জায়গায় ছিলেন, নারকীয় কোথাও—জায়গাটা নিশ্চয় অনেক উত্তপ্ত ছিল। হ্যাঁ, তাই। ঝোপের মতো সাদা ভ্রুগুলো কিছুটা পুড়ে গেছে। দাড়িটাও কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে, বিশেষ করে প্রান্তগুলো। ওখান থেকে পোড়া হাঁসের মতো গন্ধ বেরোচ্ছিল। অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন তিনি আমার দিকে। তারপর বুকপকেট থেকে একখানা ছোট্ট বুরুশ বের করে তার দাড়ি ও ভ্রুগুলো পরিষ্কার করলেন এবং করুণ স্বরে বললেন, ‘দেখুন, হে যুবক- এটা কিন্তু আপনি ভালো করেননি।’
জড়ানো কণ্ঠে ক্ষমা চাইলাম আমি। কী যে দুঃখ হচ্ছিল আমার! আমি যদি ওই তিনটি বাসনার কথা বিশ্বাস না করতাম সেই ভালো ছিল। কিংবা ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।
‘ঠিক আছে,’ মন্তব্য করলেন লোকটি। তবে এখন কিন্তু আমরা সময়ের একদম শেষ প্রান্তে,’ বলে তিনি এমনভাবে মৃদু হাসতে লাগলেন যে অশ্রু এসে যাচ্ছিল আমার চোখে। ‘এখন আপনার জন্য মাত্র একটি বাসনাই মুক্ত রয়েছে, তৃতীয়টি। আশা করি এবার এক্ষেত্রে আপনি একটু বেশি সাবধানতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। কথা দিচ্ছেন তো?’
আমি মাথা নাড়লাম এবং ঢোক গিললাম। ‘হ্যাঁ,’ তারপর জবাব দিলাম আমি, ‘তবে এই শর্তে যে আপনি আমাকে পুনরায় তুমি বলে সম্বোধন করবেন।’ এবার হেসে উঠতে হলো তাকে। ঠিক আছে বাপু,’ বলে তিনি আমাকে তার হাত এগিয়ে দিলেন। ‘সুখে থাকো। বড়ো বেশি হতাশ হবে না। তবে তোমার শেষ বাসনাটি সম্পর্কে সতর্ক হও।
“‘আমি কথা দিলাম আপনাকে,’ গাম্ভীর্যের সাথে বললাম আমি।”
“তারপর?”
“তারপর আবার কী?”
“তারপর থেকে আপনি কি সুখী?”
“আচ্ছা, আচ্ছা। সুখী?” আমার পাশের লোকটি উঠে দাঁড়ালেন। ক্লোকরুম থেকে হ্যাট ও ওভারকোটখানা হাতে নিলেন, ওর উজ্জ্বল চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন এবং বললেন, “শেষ বাসনাটি চল্লিশ বছর ধরে স্পর্শ করিনি আমি। কখনো কখনো আমি খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম ওটার। কিন্তু না ছুঁইনি। বাসনাগুলো শুধু তখনই সুন্দর, মানুষ যতদিন সেগুলো সামনে রেখে চলে। ভালো থাকুন।
আমি জানালা দিয়ে চেয়ে রইলাম, লোকটি কেমনভাবে রাস্তার ওপারে চলে গেলো। বরফের টুকরোগুলো ওর চারপাশে নেচে উঠছে। এবং তিনি আমাকে বলতে ভুলে গিয়েছেন, তিনি সুখী কি না; না কি ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দেননি? অবশ্য সেটাও অসম্ভব নয়।