• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১, ০২:১৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১, ০৩:০৭ পিএম

আত্মমর্যাদার নীতি

সভ্যতার ইতিহাস অনুবাদেরই ইতিহাস

সভ্যতার ইতিহাস অনুবাদেরই ইতিহাস

শুধু বিজ্ঞান না, এমনকি ধর্ম, দর্শন ইত্যাদিও এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় প্রবাহিত হয়েছে, এবং সাধারণভাবে দ্বিতীয় ভাষাটিকে ঋদ্ধ করেছে। বিশেষ করে একটা বিশাল সভ্যতার পাশাপাশি থাকা ‘অনগ্রসর’ জাতিগুলো প্রায়শই নানা ধারণা ধার করেছে, গ্রহণ করেছে এবং বহু ক্ষেত্রেই দাতাকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে, কিংবা মর্যাদা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়টা এমনকি হেরোডোটাসও খেয়াল করেছিলেন। প্রাচীন পারসিক জগতের যুদ্ধযাত্রার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি প্রসঙ্গক্রমে এটাও উল্লেখ করেছিলেন যে, গ্রিক দুনিয়ার প্রায় সব দেবদেবীর উৎপত্তি গ্রিসে নয়। বরং তাদের একটা বড় অংশ এসেছে সুপ্রাচীন একটি সাম্রাজ্য থেকে, সেটি মিসর। এ ছাড়া বাকিরা এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্য পুরোনো সভ্যতা থেকে। কয়েকজন মাত্র গ্রিক দেব-দেবীর কথা বলেছেন হেরোডোটাস, যারা মিসরীয় নন—এদের মাঝে সমুদ্রদেবতা পসাইডন ও দেবী হেরা কেবল উল্লেখযোগ্য।

হেরোডোটাসও বিষয়টিকে উপলব্ধি করেছিলেন এবং প্রকাশও করেছেন গল্প দিয়ে, এটা তিনি জানতে পেরেছেন গ্রিসের সবচাইতে পুরাতন জিউসের মন্দিরের নারী-পুরোহিতদের কাছ থেকে।

“দুটো কালো ঘুঘু মিসরের থিবস থেকে উড়ে এলো একটা লিবিয়া এবং অন্যটা ডোডোনা নগরে; পরেরটি একটা ওক গাছে বসল, এবং সেখানে মানুষের কণ্ঠে কথা বলল, ঘোষণা করল জিউসের জন্য একটা দৈববাণীর স্থান সেখানে স্থাপন করতে হবে। ডোডোনার মানুষেরা বুঝতে পারল বার্তাটা ছিল ঐশী, কাজেই তারা সেখানে একটা দৈববাণীর মন্দির স্থাপন করল। লিবিয়াতে যাওয়া ঘুঘুটা লিবীয়দের বলল আম্মোনের একটা দৈববাণীর স্থান স্থাপন করতে, এটাও জিউসেরই দৈববাণীর স্থান।”

হেরোডোটাস বলতে চেয়েছেন যে, গ্রিক পুরোহিতরাও এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন ছিলেন যে তাদের প্রধান দেবতা জিউসের ধারণাটিও এসেছে মিসর থেকে। এরপর হেরোডোটাস আলোচনা করেছেন ডায়োনিসাস, হারকিউলিস এবং অন্যান্য আরও বেশ কিছু দেব-দেবী নিয়ে। মিসরীয়রা অবশ্য হেরোডোটাসকে অন্য কাহিনি বলেছে, সেটা হলো মিসরের থিবস নগর থেকে দুজন নারী পুরোহিতকে অপহরণ করেছিল ফিনিশীয় জলদস্যুরা, এবং তাদের একজনকে বিক্রি করা হয় লিবিয়াতে, অন্যজনকে গ্রিসের ডোডোনাতে। হেরোডোটাসের সহজ ব্যাখ্যা: ঘুঘুরা কালো, কারণ তারা মিসরীয়। তারা পাখির ভাষা থেকে মানুষের ভাষায় কথা বলেছে, কারণ কিছুদিন পর তাদের কিচিরমিচিরকে বোধগম্য বাক্য মনে হয়েছে গ্রিকদের কাছে।

এটা তাই কাকতাল নয় যে, গ্রিসের মাঝে অ্যাথেন্স গুরুত্বপূর্ণ নগরী হয়ে যাওয়ার আগেকার সময়ে, এবং বিশেষ করে পারস্যের উত্থানের কারণে এশিয়া মাইনরের গ্রিক নগরগুলো স্বাধীনতা হারানোর আগেকার সময়ের গ্রিক দার্শনিক, গণিতবিদ ও জ্ঞানীদের বড় অংশটিই ছিলেন মূল গ্রিক ভূখণ্ডের বাইরের এই নগরগুলো। কেননা, মূল গ্রিসের তুলনামূলক স্থির জীবনের চাইতে এই নগরগুলো অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল মিসর, লিডিয়া, মিডিয়া, ব্যাবিলন প্রভৃতি সভ্যতা ও জ্ঞানের প্রাচীন কেন্দ্রগুলোর সাথে। ফলে তারা একেকটা রীতিমতো অনুবাদকেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বাকি দুনিয়ার সাথে গ্রিসের যোগাযোগে।

অনুবাদে আসলে শুধু প্রযুক্তি কিংবা প্রাকৃতিক জ্ঞানেরই প্রবাহ ঘটে, তাই নয়, প্রকৃতিঘনিষ্ঠ মানুষের সমাজ যখন জটিল উৎপাদনী প্রক্রিয়ায় যেতে থাকে, নগর ও সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে নৈতিকতার নতুন নতুন ধারণা, এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কেরও পরিবর্তন আসতে থাকে, তখন হয় এটা একটা সমাজ একদম নতুন করে তৈরি করে, অথবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশী সভ্যতাগুলো থেকে সেগুলোকে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করে। ধর্মের বিষয়েও এমনটা ঘটেছে, আদিবাসীদের সমাজগুলো বদলে যাবার সাথে সাথে সরল ধরনের প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর উপাসনার বদলে জটিল রাষ্ট্র ও সমাজের উপযুক্ত ধর্ম-দর্শনের চাহিদা তৈরি হয়, ভারতবর্ষের বেলাতেও দেখা যাবে কৃষিসমাজের বিস্তারের সাথে সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ও শেষ পর্বে খ্রিষ্টধর্মের বিস্তার ঘটেছে।

এই রকম উদাহরণ চীন ও পারস্যের বেলাতে দেখা যাবে, মধ্য এশীয় তুর্কি ও মোঙ্গল জাতিগুলোকে তারা বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তাদের বিকাশের পর্বগুলোতে রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয় ধারণাগত উপাদানগুলো সেখান থেকেই তারা বিপুল হারে গ্রহণ করেছে। রোমান সাম্রাজ্যের বেলায় এটা এক সময়ে এসেছে ইউরোপীয় স্লাভ ও জার্মান জাতিগোষ্ঠীগুলোর বেলায়। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যের সাথে প্রান্তের সমাজগুলোর এই লেনদেনের সময়ে তাদের সম্পর্কটা অধিকাংশ সময়েই মধুর ছিল না। কিন্তু জ্ঞানের প্রবাহ ছাড়া দ্বিতীয় সর্বদাই অধস্তনের ভূমিকাতেই থেকে যেত। আর অনুবাদ সেই জ্ঞান-প্রবাহের একমাত্র মাধ্যম। এর আগে আরবরা প্রভাবিত হয়েছে পারসিক ও রোমান সাম্রাজ্যের নানান ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারার সাথে সংস্পর্শে। একই সাথে পরের অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু গ্রহণ করা এবং নিজের বিকাশের প্রয়োজনে সেটাকে ব্যবহার করার মাঝেই প্রতিটা নতুন সভ্যতার বিকাশের ইতিহাসটাকে পাঠ করা যাবে।

কিন্তু একই সাথে মনে রাখাটা দরকার, নতুন করে চাকা আবিষ্কার করাটা যেমন বোকামি, তেমনি আবার সব ধরনের চাকা সব ভূগোলে চলবেও না। সে জন্যই দরকার স্থানিকীকরণ। বিজ্ঞান, গণিতের যেমন সর্বজনীন ব্যাপার রয়েছে, প্রযুক্তির বেলাতে রয়েছে কিছুটা বিজ্ঞান ও কিছুটা ভৌগোলিক-সামাজিক বাস্তবতা। কিন্তু মানববিদ্যার বেলাতে এসে নিতে হয় তার অন্তর্গত শিক্ষাটা। অগ্রসর দুনিয়া থেকে সমাজসংগঠন এবং রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার অনেকগুলো দার্শনিক ধারণা ও সংগঠন কাঠামো অন্যরা গ্রহণ করেছে। এতে সংকোচের কিছু নেই, এবং নিজেদের খাঁটিত্ব ধরে রাখতে গ্রহণ না করার নীতিটিই হলো আত্মহননতুল্য। কিন্তু তাই বলে গ্রহীতা যে চিরকাল ঋণীই থাকবে, তার মৌলিকভাবে দেওয়ার কিছু নেই, বিষয়টা এমনও নয়। দুই হাতে গ্রহণ করা গ্রিকরাও মানবসভ্যতাতে ঋণী করেছে দর্শন ও বিজ্ঞানে অজস্র নির্মাণের মাধ্যমেও।

এই কারণেই জ্ঞানের ইতিহাস আসলে অনুবাদেরই ইতিহাস। সভ্যতার ইতিহাসকেও অনুবাদের আয়না দিয়েই পড়ে ফেলা যায়।