• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১, ০২:২৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৩:০৯ পিএম

আত্মমর্যাদার নীতি

অনুবাদ বৈচিত্র্যের মাঝে সত্যিকারের যোগসূত্র 

অনুবাদ বৈচিত্র্যের মাঝে সত্যিকারের যোগসূত্র 

আইজাক আসিমভের ‘রক্ত সম্পর্কে আমরা যেভাবে জানলাম’ লেখাটির অনুবাদ পড়তে গিয়ে ভীষণ অবাক হলাম! সবাই জানি ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে ১৬২৮ সালে দেহে রক্তসংবহন প্রণালি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি গ্রিক বিজ্ঞানী গ্যালেনের ১৩০০ বছর পুরনো তত্ত্ব বাতিল করে হৃদপিণ্ড থেকে সারা দেহে রক্ত যেভাবে চলাচল করে তা দেখিয়েছিলেন। আসিমভ থেকে জানলাম এটা আসলে একটা মধ্যযুগীয় আবিষ্কার, হার্ভের প্রায় ৪০০ বছর আগেকার। ইবনে নাফিস (১২১০-১২৮৮ খৃষ্টাব্দ) নামের মধ্যযুগের একজন বহুমুখী পণ্ডিত, যিনি একাধারে চিকিৎসা, ভূগোল, রসায়ন, ধর্মতত্ত্ব এবং আরও অজস্র বিষয়ে মৌলিক কাজ করেছেন, তিনিই গ্যালেনর তত্ত্বকে প্রথমবার বাতিল করেছেন। তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ল্যাতিনে অনূদিত হয়েছিল, যেগুলোর সন্ধান আধুনিক গবেষকরা পেয়েছেন। এবং উল্লেখযোগ্য যে, হার্ভে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন ইতালিতেই, পদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

হার্ভে নাফিসের রচনার সাথে পরিচিত ছিলেন বলেই অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন (আগ্রহীরা এই বিষয়ে মার্কিন সরকারী সংস্থা এনসিবিআইয়ের সাইটে এই লিঙ্কের লেখাটি দেখতে পারে t.ly/Y7Ev ), হার্ভে তার পূর্বসূরী মিখাইল সার্ভেন্টাসের (১৫১১-১৫৫৩) লেখা থেকেও অনুপ্রাণিত হতে পারেন, যিনি ইবনে নাফিসকে পড়েছেন বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। ইবনে নাফিসও কিন্তু কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়। তাদের মতো অজস্র জ্ঞানীগুনীর জন্মটা সম্ভব হয়েছিল মধ্যযুগের সূচনা লগ্নে আরব সভ্যতাগুলোতে বিপুল পরিমাণে অনুবাদ যজ্ঞের কল্যাণে। নাফিস ও এমনি বহু আরব পণ্ডিতের লেখা যেমন টিকে আছে কেবল তাদের ল্যাতিন অনুবাদের কল্যাণে, তেমনি প্রাচীন যুগের গ্রিক সাহিত্য ও দর্শনের একটা বড় অংশ মধ্যযুগে টিকে গিয়েছিল সেগুলোর আরবী অনুবাদের সুবাদে।

অনুবাদের এই বিপুল যজ্ঞ একেকটা সভ্যতার অগ্রগতির সূচনা-স্মারক। জগতে যে রাষ্ট্রই যখন সভ্যতার বুকে নিজের ছাপ ফেলতে পেরেছে, তার সহগামী হিসেবে সেখানে এসেছে অনুবাদের বিপ্লব। অনুবাদ পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানকে একটা ভাষায় নিয়ে এসে যে সামাজিক আলোড়নটি তৈরি করে, তার প্রভাব হয় বহুমুখী। প্রথমত, সারা পৃথিবীর কাজের সাথে জনগোষ্ঠীকে পরিচিত করে। দ্বিতীয়ত, জনগণের ভাষায় সেগুলো রচিত হবার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে সেই বিষয়ে আগ্রহের বিস্তার ঘটে। কদিন আগেই অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ যেমন লিখেছেন ‘জানার পথে ভাষার দেয়াল’ নামের একটা প্রবন্ধে, অর্থনীতি, পানিনীতি, পরিবেশনীতি, চিকিৎসানীতি সহ বাংলাদেশে যত ধরনের নীতিনির্ধারণ করা হয়, তার কোন কিছুই বাংলাতে হয় না বলে এই দেশের মানুষ সেগুলোর ভুলশুদ্ধ ধরতে পারে না, জানতেও পারে না। অনুবাদের কারণে তৃতীয়ত যা হয়, তা হলো, ভবিষ্যতের যারা বিজ্ঞানী হবেন, দার্শনিক হবেন, সেই ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মাঝে অনুসন্ধিৎসা তৈরি হয়।

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, সেটা হলো মধ্যযুগের একটা বড় সময় জুড়ে আরব বিজ্ঞানীদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের পাশাপাশি ইউরোপের নানান দেশে তুলনামূলক কম সংখ্যক অভিজাত, সুবিধাপ্রাপ্ত বা নগরবাসী জনগোষ্ঠীর মাঝে জ্ঞানচর্চা হতো। এর বড় কারণ সেখানে উচ্চজ্ঞান সীমিত ছিল ল্যাতিন ভাষায়, যেটা সাধারণের স্তরে পৌঁছাতো না। এর অবসান ঘটেছিল মধ্যযুগের শেষ দিকে সাম্রাজ্যগুলোর ভাঙন ও ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রগুলোর বিকাশের সময়টাতে, তখন দেশে দেশে মাতৃভাষায় জ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতি হয়। ল্যাতিন থেকে এই বইগুলো স্থানীয় সব ভাষাতে অনুদিত হতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয়টা খেয়াল করেছিলেন বিখ্যাত বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন বোস, জাপানের বিপুল অগ্রগতির পেছনে তিনি দেখেছিলেন অনুবাদের বিপুল জোয়ারের একটা ভূমিকা। জাপানে ১৮৮০ দশকে প্রথম পশ্চিমা ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বহু বৃটিশ উপনিবেশের পরেকার ঘটনা। কিন্তু বছর তিরিশেকের মাঝেই তারা প্রায় সকল প্রয়োজনীয় বিদেশী ভাষার বইপুস্তক মাতৃভাষায় অনুবাদ সম্পন্ন করে ফেলে। ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে  জাপানে সফরকালে সত্যেন বোস আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেন জাপানী অধ্যাপকরা দর্শন-পদার্থবিদ্যা-চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে জাপানী ভাষাতেই আলাপ করছেন। তারা সত্যেন বোসকে জানালেন যে তারা কেউ কেউ ইংরেজি পারেন বটে, কিন্তু তাতে মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায় বলে মনে করেন না। এই প্রসঙ্গে সত্যেন বোস জানিয়েছেন একটি আশ্চর্য ঘটনা, যা এখনও অপ্রাসঙ্গিক নয়।

সত্যেন বোস এখানে একটা মজার ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশেও এর প্রাসঙ্গিকতা আছে।

“পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে দুজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইংরেজীতে লেখা একটি বইয়ের জাপানী তর্জমা হয়েছে। আমায় জানানো হলো ওই বইটি বেশ ভালোই বিক্রি হয়েছে ছয় মাসে, প্রায় তিন হাজারের মত। শুধু জাপানী ভাষাই পড়তে পারেন এমন সাধারণ জাপানীরা পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল জানবার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং হয়তো তারা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভারতীয় মতামতকেই বেশি বিশ্বাস করেন অন্যদের চাইতে।”

এর পরই সত্যেন বোসের আক্ষেপ:

“তবু আমাদের দেশে ওই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা ইংরাজিতেই লিখে চলেছেন ও তার ফলে তাদের দেশবাসীর ৮০ ভাগকেই অজ্ঞ রেখেছেন পারমাণবিক বিপদ সম্পর্কে।”

 
শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান নয়, পারমানবিক বিপদ হোক অথবা হোক সরকারী নীতিনির্ধারণের বিষয়ে, মাতৃভাষার বিকল্প নেই। সত্যেন বোসের জাপান নিয়ে এই অভিজ্ঞতাটি পাঠ করার পর আবার পড়া যাক আনু মুহাম্মদের সাম্প্রতিক একটা লেখা ‘জানার পথে ভাষার দেয়াল’ থেকে একটি অংশ, তাতেই বোঝা যাবে মাতৃভাষায় জ্ঞানের প্রসারে কেন ইংরেজিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো টিকিয়ে রাখার আগ্রহ:


“...আরও আছে। বাংলাদেশে বর্তমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সরকারিভাবে নিজেদের সব উন্নয়নকাজের চালিকা শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এসব পরিকল্পনা দলিল তার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৈরি বিভিন্ন গবেষণাপত্র সবই ইংরেজি ভাষায় প্রণীত। জনগণ তো দূরের কথা, সেগুলো দেশের বিদ্যায়তনগুলোতেও সুলভ নয়। বাস্তবে এখন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির লক্ষ্য হিসেবে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের জন্য নিয়মিত অগ্রগতি রিপোর্ট প্রণয়ন করে থাকে। ব্যস্ততা এ কাজেই বেশি, আর এগুলো সবই লেখা হয় ইংরেজিতে। বাংলাদেশের মানুষের অজানাই থাকে সরকার তাদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করছে, তাদের অগ্রগতির কী কী রিপোর্ট আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থিত করছে।”


দুনিয়াটাকে অল্প কয়েকটি প্রভাবশালী ভাষার কারাগারে আটকে রাখার চেষ্টা ক্ষমতাদর্পীদের সুবিধা এনে দেয়, মানুষের দুনিয়া গড়তে প্রয়োজন ভাষাগুলোর মাঝে অনুবাদের সম্পর্কসেতু তৈরি করা।