বাংলা ভাষায় নদীবিষয়ক প্রথম গ্রন্থটি লিখেছিলেন কপিল ভট্টাচার্য নামের একজন নদী বিশেষজ্ঞ। ১৯২৮ সালে শিবপুর বেঙ্গল প্রকৌশল ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন ফ্রান্সে। ইংরেজি ও ফরাসি দুই ভাষাতেই দখল ছিল দুর্দান্ত। ভারতে সেই আমলে প্রকৌশলী, বিশেষ করে নদী বিশেষজ্ঞ খুব বেশি ছিল না। হাতে গোনা কয়েকজনেরই একজন কপিল।
কপিল ভট্টাচার্যের বাংলায় নদীবিষয়ক গ্রন্থ লেখার পেছনের কাহিনিটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত। বহু অর্থেই কপিল ভট্টাচার্য রচিত বাংলা দেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ। প্রথমত, বাংলাদেশের নদী, এর বৈচিত্র্যপূর্ণ গঠন ও প্রবাহ নিয়ে বাংলা ভাষায় এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ; দ্বিতীয়ত, যে প্রজ্ঞা ও বোধ থেকে লেখক এই গ্রন্থটি রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, তার অভাব আজও এ দেশের নদী বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাকারীদের মাঝে নিত্য দৃশ্যমান।
কিন্তু প্রকৌশলীর জ্ঞান পরিবেশবাদীর প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত হওয়ার চাইতেও বেশি কিছু শিক্ষণীয় আছে তার এই গ্রন্থ রচনার ঘটনায়। উপনিবেশের অবসানের পরও তিনি উপনিবেশেরই ধারাবাহিকতা আবিষ্কার করলেন শাসকদের ধ্যান-ধারণার মাঝে। নেহরুর ধারণায় বাঁধ ছিল আধুনিক ভারতের মন্দির। অন্যদিকে কপিল দেখতে পাচ্ছিলেন একদিকে বড় বাঁধ নির্মাণে বড় বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ এবং সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্বিপাক। নদীর স্রোত, গতি, জনজীবন বিবেচনায় না নিয়ে এসব স্থাপনা এর মাঝে যা দুর্দশা নিয়ে এসেছিল, সেগুলো নিয়ে তিনি নিয়মিত ভিন্নমত জানাতেন। একজন নদী বিশেষজ্ঞ হিসেবে কপিল ভট্টাচার্য সর্বদা উপলব্ধি করেছেন নদী এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের প্রাণ। এর সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
ফারাক্কা বাঁধের প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, কপিল তখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রধান প্রকৌশলীর সরকারি দায়িত্বে আসীন। ফারাক্কা প্রকল্পটির সব কারিগরি বিবরণ রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতো, ভারত সরকার এই বিষয়ক কোনো তথ্য প্রকাশ্যে প্রচার করেনি, যাতে বিশেষজ্ঞরা সেটি যাচাই-বাছাই ও মতামত দিতে পারেন, সর্বসাধারণের মতামত নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ফারাক্কা বাঁধসহ অনেকগুলো প্রকল্প নিয়ে কপিল ভট্টাচার্য নিজস্ব মতামত সরকারি নদী কমিশন ও অন্যান্য সরকারি দফতর ও সংস্থায় পাঠাতেন, বিকল্প সুপারিশ হাজিরও করতেন। অচিরেই তিনি উপলব্ধি করলেন, জনস্বার্থ নয়, নীতিনির্ধারকরা আসলে নিজেদের মর্জিমাফিকই চলছেন, নিজেদের প্রকল্প নির্মাণ স্বার্থটাই তাদের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
কপিল ভট্টাচার্যের তাই মনে হলো, সরকার তাঁর কথা শুনছে না, শুনবেও না। নদীর কোনো মালিক হয় না, তবু দায়বদ্ধতাহীন পরিকল্পকদের চাইতে নদীগুলোর ওপর যাদের অধিকার বেশি, সেই জনগণকেই শোনানো দরকার। তাদেরকেই সচেতন করা দরকার, যাতে তারা তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে আসেন, তার ভিত্তিতে সমবেত হন, সেই রকম চেতনা ও রাজনীতি দেশ জুড়ে যেন গড়ে ওঠে। এই কারণে তিনি নানান পত্রপত্রিকায় বাংলা ভাষায় নদী, নদীর গঠন, ভারত ও বাংলা এলাকার নদীগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে লেখা শুরু করলেন। তিনি নদী নিয়ে সরকারি পরিকল্পনাগুলো কেন ত্রুটিপূর্ণ, সাময়িক কিছু সুফল দিলেও কেন অচিরেই তা অনেক বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সেটাও ব্যাখ্যা করলেন, বাংলা ভাষাতেই। যান্ত্রিকভাবে প্রকৌশল জ্ঞান প্রয়োগ করাটা কেন ভুল, প্রতিটি নদীর বিশেষত্ব আলাদা করে কেন খেয়াল করতে হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নদী শাসনের অভিজ্ঞতাও কেন বাংলায় সরাসরি প্রয়োগ করা যাবে না, সেটাও তিনি লিখলেন।
এইভাবে কপিল ভট্টাচার্য শাসকদের কাছে ইংরেজি ভাষায় কাকুতি-মিনতি করবার বদলে জনগণের কাছে মাতৃভাষায় নদী নিয়ে তার যা কিছু জ্ঞান, যা কিছু প্রজ্ঞা, সেটা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন। মানুষের মাঝে মালিকানার বোধটিকে জাগিয়ে দিতে চাইলেন, চাইলেন জবাবদিহিহীন আমলা-ভাড়াটে বিশেষজ্ঞের হাত থেকে নদীবিষয়ক পরিকল্পনার একচেটিয়া কারবারের অবসান ঘটাতে। এভাবেই জন্ম দিল বাংলাভাষায় প্রথম নদীবিষয়ক গ্রন্থ ‘বাংলা দেশের নদ-নদী’।
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণেই তিনি ঘোষণা করেন, সরকারি পরিকল্পনার ভ্রান্তি ও ভাওতা সাধারণ জনগণকে বোঝানোই তাঁর এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য। তথাকথিত নদী উন্নয়নের নানা পরিকল্পনা যে জনগণের জন্য সমূহ বিপদই বয়ে নিয়ে আসছে, এবং সে বিষয়ে তাদের সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তোলাই যে বাঁচার একমাত্র পথ; তা তিনি নিজে যেমন বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারে হাজির থেকে সে বিশ্বাসের প্রমাণও তিনি দিয়েছেন।
ঔপনিবেশিক যুগের রেল ও সড়ক যোগাযোগের ‘প্রগতি’তে প্রশ্নহীন আনুগত্য ছিল না কপিল ভট্টাচার্যের। বরং ফ্রান্সসহ বহু ইউরোপীয় দেশের উদাহরণ দেখিয়ে তিনি জলপথের নাব্যতা সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রদর্শন করেছেন। এমনকি নদীপথকে বিপর্যস্ত করা সড়ক ও রেলপথের প্রতিক্রিয়ায় দেশে জমির উর্বরতা বিনষ্টিসহ বিপুল জলাভূমির আবির্ভাবে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এবং জনস্বাস্থ্যের হানিও তাঁর চোখ এড়ায়নি। প্রত্যক্ষ উপনিবেশের উত্তরকালেও বিদেশি পরিকল্পনাকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাতা এবং পুঁজি বিনোয়াগকারীদের কর্তৃত্বে নদী শাসন পরিকল্পনা ও বাঁধ নির্মাণ অব্যাহত থাকল। সেটার বিরুদ্ধেই আজীবন লড়েছেন কপিল ভট্টাচার্য। ফারাক্কা বাঁধসহ দামোদর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে গ্রহণ করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা করেননি কপিল ভট্টাচার্য। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে নদী ব্যবস্থাপনার নীতি গ্রহণে যে ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সহযোগিতা ও পরস্পরের মিত্রতা জরুরি, তা-ও তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। ফারাক্কা প্রশ্নে তাঁর এই আপসহীন অবস্থানের কারণে সরকারি মহল তাকে যথারীতি উপেক্ষা ও হয়রানি করতেও কসুর করেনি।
খুবই সত্যি যে কপিল ভট্টাচার্য শেষ জীবনে যথেষ্ট হেনস্তা আর নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে শুধু পুলিশের হয়রানির শিকার হওয়া নয়, ফারাক্কা বাঁধ ভারতের বিপুল পরিমাণ জনগণের জীবনেও অভিশাপ নিয়ে আসবে, এমন মত প্রকাশ করার কারণে তাঁকে পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাতে ভারতের গণমাধ্যমও ভূমিকা রেখেছিল। আজকে কিন্তু পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। বিগত এক দশক ধরে কপিলের ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করেছে, বিহার ও উত্তর প্রদেশের একটা বড় অংশ বন্যার বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশ হচ্ছে ভাঙনের শিকার। এবং কপিল সেখানকার গণমাধ্যমে বারবার আলোচিত হচ্ছেন তাঁর সেই বিপর্যয়ের আগাম অনুমানের কারণে।
এভাবে বাংলা ভাষায় প্রথম নদীবিষয়ক গ্রন্থের কর্তা তাঁর সমকালের চাইতে এখন অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছেন। কিন্তু তবু বলি, নদী ও মানুষের গভীর সম্পর্ক বিষয়ে নজর ফেরানোর বিপুল কাজের বাইরেও বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে এই নিজ ভাষায় রচনার প্রেরণাটির তাৎপর্যও একেবারে খাটো নয়। নিজের মাতৃভূমিকে, নিজের পরিবেশকে জনগণ যদি একদিন নিজের বলে চিনতে পারেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থ লুণ্ঠনের বদলে নদী কিংবা পাহাড়কে যদি কোনো দিন জীবনের বিচিত্র বিকাশের উপায় হিসেবে ভাবার চিন্তাধারা কখনো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, বিউপনিবেশায়নের দার্শনিক শক্তি আমাদের দেশে কখনো যদি সত্যিকারের প্রবল হয়, কপিল ভট্টাচার্যের মুকুটে তখন দুটো বড় পালক দেখতে পাওয়া যাবে। একটা নদী রক্ষার আকুতির, অন্যটি ভাষার শক্তি আবিষ্কারের।