মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিমান বাহিনীর দুর্ধর্ষ অভিযানের নাম ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’। কিভাবে এই সুইসাইড স্কোয়াডটি গঠন করা হলো? জীবনবাজি রেখে কিভাবে তারা অপারেশনগুলো করতেন? এমন প্রশ্নগুলো নিয়ে অপারেশন কিলো ফ্লাইটের অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলীর (বীরপ্রতীক) মুখোমুখি হয়েছিলাম।
রুস্তম আলী তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, চট্টগ্রাম কলেজের। পাকিস্তান এয়ারফোর্সে লোক নেওয়ার খবরটি পেয়ে যান রিক্রুটিং সেন্টার মেহেদিবাগে। টিকে যেতেই বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, কোয়েটা ট্রেনিং সেন্টারে। পরে ট্রেডভিত্তিক ট্রেনিংয়ের জন্য আসেন করাচিতে। কাজ করেছেন সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি সারগোদায়ও। তার পদ ছিল এলএসিএম, সার্ভিস নম্বর ছিল ৮৩১৮৯। বিমানে রকেট, বোমা, মিসাইল, মেশিনগান প্রভৃতি ফিট করাই ছিল তার কাজ।
১৯৭০ সালে দেশে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর বড় বন্যা হয়েছিল। তিনি তখন সারগোদায়। ঘোষণা করা হলো চাইলে ছুটিতে যেতে পারবেন। তাই দুই মাসের ছুটি নিয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি গ্রামে ফেরেন। কিন্তু ছুটি শেষে তিনি আর ফিরে যাননি। পাকিস্তানি সেনারা সারা দেশে গণহত্যা চালাতে থাকলে এই যোদ্ধা তখন চট্টগ্রামের কুমিরায় প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর মিরেরসরাইয়ের গোরলগঞ্জ হয়ে চলে যান ভারতের হরিণা ক্যাম্পে। ডিফেন্সের লোক শুনতেই দুদিন পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। তখন শত শত ছাত্র-যুবক আসছে ট্রেনিং নিতে। তাদের ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ক্যাম্পে। রুস্তম আলীও একটি গ্রুপকে ট্রেনিং করান ও বর্ডারে ছোট ছোট অপারেশন করেন।
রুস্তম তখন আগরতলায়, হোল্ডিং ক্যাম্পে। সঙ্গে খন্দকার আর সার্জেন্ট মনির। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন করা হবে। সে কারণে চলছে বিভিন্ন ট্রেডের লোক সংগ্রহ। ফলে রুস্তম আলীদেরও নিয়ে যাওয়া হয় ডিমাপুরে, আসামের নাগাল্যান্ডে। বাকি ইতিহাস শুনি এই বীরপ্রতীকের মুখেই। তার ভাষায়—
“চারদিকে পাহাড়। মাঝখানে একটা ব্রিটিশ আমলের রানওয়ে। সেখানেই কয়েক মাস চলে ট্রেনিং। একটা এলইউট আর ছিল একটা অর্টার। এলইউট হলো হেলিকপ্টার। আর অর্টার হচ্ছে বিমান। একটি বিমানে রকেট, বোম্বিং, গানারিং এই তিনটা সেট করা থাকত। আমি ছিলাম এয়ার গানার। বিমানবাহিনীর তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (বীরউত্তম) ছিলেন পাইলট। কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম। আমি এয়ার গানার আর সার্জেন্ট হক ছিলেন বম্ব ড্রপিংয়ের দায়িত্বে।
ট্রেনিংয়ের সময় পাহাড়ের মধ্যে আমাদের টার্গেট দেওয়া হতো। সেটি ধ্বংস করতাম। এলইউট বা হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ আর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম। আরেকটা বিমান ছিল ড্যাকোটা। সেটার পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেক। সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন ও আব্দুল মুহিতও। সবাই ছিলাম সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। মেইন অপারেশনে আমি এলইউট ও অর্টার দুটিতেই কাজ করেছি। একটি শেষ করেই উঠতাম আরেকটিতে। গ্রুপটির নাম ছিল ‘কিলো ফ্লাইট’। কমান্ডার সুলতান মাহমুদ।”
প্রথম এয়ার ফাইটের কথা শোনান বীরপ্রতীক রুস্তম আলী, “ইন্ডিয়ান বর্ডারে ছিল কৈলাশহর এয়ারপোর্ট। আমাদের নিয়ে আসা হয় সেখানে। এক রাতের পরই বলা হলো অপারেশনের কথা। গোপনীয়তা রক্ষায় কোথায় অপারেশন করতে হবে জানানো হলো না। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাত তখন বারোটা। সবাই প্রস্তুত। বিমানযুদ্ধ ওটাই ছিল প্রথম। বিমান বা অর্টারে ফ্লাই করার আগে জানানো হয় চট্টগ্রাম অ্যাটাক করতে হবে।
আমরা চারজন—ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম পাইলট, কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম, এয়ার গানার আমি আর সার্জেন্ট হক বম্ব ড্রপিংয়ে। রাত তখন দশটা। কৈলাশহর থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার দিয়ে বিমানটি উড়ে যায়। যাতে পাকিস্তানি রাডারে তা ক্যাচ না করে। চিটাগাং দিয়ে ঢুকতেই সীতাকুণ্ড, পরে পাহাড়। যখন পাহাড় ক্রস করছিলাম তখন শামসুল আলম সাহেব বলেন ‘রুস্তম, নাও উই আর ক্রসিং সীতাকুণ্ড হিল।’ আমি বলি, ইয়েস স্যার। দিস ইজ মাই নেটিভ থানা।
অতঃপর আমরা বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করি, একেবারে নিচে নেমে। অনেক নিচ দিয়ে ফ্লাই করছি আমরা। চাঁদের আলো ছিল। নিচে সব দেখা যাচ্ছে। আকাশে এক-দুইটা চক্কর দিয়েই আসি চিটাগাং, ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারিতে। ওটা ধ্বংস করাই ছিল টার্গেট। প্রথমবারেই রকেট, মেশিনগান, বোমা একসঙ্গে শুরু করলাম। আমি মেশিনগানের গুলি চালাই আর বম্ব ড্রপ করে সার্জেন্ট হক। প্রথম অ্যাটাকেই দাউদাউ করে আগুন লেগে গেল। বিকট আওয়াজ হচ্ছিল। শামসুল আলম সাহেব বলেন ‘শুড আই টেক অ্যানাদার অ্যাটেম্পট।’ আমি বলি ‘নো স্যার, উই আর সাকসেসফুল।’
পাকিস্তানিরা প্রথম মনে করেছে এগুলো তাদের বিমান। তাই ওরা প্রথমে কিছু করেনি। ধ্বংস আর আগুন দেখে ওরা পাগল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম তখন ওদের নেভালের দুর্গ। নেভি আর আর্মিরা অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান দিয়ে গুলি করতে শুরু করে। একটা লাগলেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। একাত্তরে এভাবে মরতে মরতে আমরা ফিরে এসেছিলাম।”
ফেরার সময় রুস্তম আলীরা বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের কুম্বিরগ্রামে ল্যান্ড করেন। তাদের সফলতা দেখে ভারতীয়রা বিশ্বাসই করতে পারেনি। ওরা অবাক হয়ে বলত ‘এই বিমান চালিয়ে তোমরা কেমনে যুদ্ধ করলে!’
রুস্তমদের মতো যোদ্ধারা তখন দেশের জন্য পাগল। তাই অসম্ভবও সম্ভব হয়েছিল। এরপর তাদের ব্যাচকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে এয়ার অ্যাটাক করা হয় সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকায়।
এই বীরপ্রতীক চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে দেশ নিয়ে বলেন, “এটা সোনার খনি, দেশ নয়। বিমানবাহিনীতেই ছিলাম। পঁচাত্তরের জুনে বেসরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাই ওমানে। এরপর জাপান, লন্ডনসহ পৃথিবীর প্রায় ২৫টি দেশ ঘুরেছি। এদেশের মতো উৎপাদনশীলতা, আবহাওয়া, মাটি, পানি আপনি কোথাও পাবেন না। এত মানুষ থাকার পরও অল্প টাকায় চাল আর সবজি খেতে পারি। এটা কোথাও নেই। এখনো স্বপ্ন দেখি সুখী, সমৃদ্ধি ও শান্তির বাংলাদেশের।”
অনেকে বলে দেশ স্বাধীন হয়ে কী পেয়েছি? মুক্তিযোদ্ধাদের অমর্যাদাও করেন কেউ কেউ। তখন কষ্ট পান বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী। বললেন, “একটা পতাকা আর দেশ পেয়েছি। নিজের দেশের পাসপোর্টও পাই। অথচ স্বাধীনতার মূল্যায়ন যখন কেউ করে না তখন খারাপ লাগে। স্বাধীনতা তো অনেকেই হাতের মোয়া হিসেবেই পেয়ে গেছে। কষ্টটা চোখে দেখেনি। ভিয়েতনামে যুদ্ধ হয়েছে বাইশ বছর। আমরা আরও দশ-বারো বছর যুদ্ধ করে দেশটা পেলে, সবাই স্বাধীনতার অর্থটা বুঝতে পারত।”
শত বাধা পেরিয়ে দেশটা একদিন উন্নত বাংলাদেশ হবে এমনটাই মনে করেন বীরপ্রতীক রুস্তম আলী। তার বিশ্বাস লাখো শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশ কখনো পথ হারাবে না। এই যোদ্ধা তাই স্বপ্নের বীজ বোনেন পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “দেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু—ইতিহাসের এই তিন বিষয়ে তোমরা আপস কোরো না। দেশের বীরত্বের ইতিহাসটি জেনে নিয়ো। দেশটাকে ভালোবেসো। মনে রেখো, নিজের কাজটা সততার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম।”
লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক