• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২১, ০৬:৫৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৩, ২০২১, ০৬:০৩ পিএম

রতনচূড় ও মৃত্যু সংক্রান্ত

রতনচূড় ও মৃত্যু সংক্রান্ত

সকাল সকাল এ বাড়িতে কী উৎপাত শুরু হল সেটা দেখার জন্য বাইরে এসে দেখি বড়ো আপা, সেজো আপা ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে আছে।

কাল অনেক রাতে এসে পৌঁছেছি আমি। একটু যে ঘুমাব, তার আর জো নেই। চোখ কচলাতে কচলাতে বড়ো আপার সামনে গিয়ে বসতেই আপা বলল, তার ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে। আমি মনে মনে মুখ বাঁকালাম। আজকালকের ছেলে, নিশ্চয়ই প্রেমটেম আছে। একাধিক থাকলেও অবাক হব না। অযথা আমাদের কেন খাটতে বলা? শুকনো হাসি হেসে বললাম, “ওর পছন্দ টছন্দ আছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখো আগে।” 

আপা আমাদের দিকে তাকিয়ে এবার বাংলা সিনেমার মায়ের মতো গদগদ গলায় কথা বলতে লাগল। তার ছেলে মায়ের পছন্দ ছাড়া বিয়ে-ফিয়ে নাকি করবে না, ছেলে এখনো মাকে না-বলে কোনো কাজই করে না ইত্যাদি।

এবার সেজো আপাও শুরু করল তার কন্যাদ্বয়ের গুণকীর্তন। এক পর্যায়ে মনে হলো এরা কেউ কারোটা শুনছে না। যে যারটা বলে যাচ্ছে। অগত্যা আমিই হাই তুলতে তুলতে চোখেমুখে মনোযোগ ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।

খিদেও যা পেয়েছে! কাল অত রাতে আর কিছু মুখে দিইনি। সকাল সকাল এত লোক জমা হয়ে গেছে যে, রান্নার মহিলাটির নাগাল পাওয়া মুশকিল। চা-নাস্তা সহজে পাব বলে তো মনে হয় না।

এ বাড়িতে একসাথে এত লোক এর আগে বহুদিন হয়নি। কেমন একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। কেউ দেখলে বুঝবে না বাড়ির সবচেয়ে মুরুব্বি মানুষটি মৃত্যুশয্যায় পড়েছে!

আমি ভেবেছিলাম ভোরবেলাতেই কথাটা সেরে ফেলব। কিন্তু এত হট্টগোলের মধ্যে সুযোগ পাব কিনা বুঝতে পারছি না। তাছাড়া দাদির কানের সমস্যাটাও তো বহুদিন ধরে। এক একটা শব্দ বুঝতে তার দশ মিনিট লেগে যায়। নিরিবিলিতে বলতে হবে কথাটা। আমি তার ঘরের দিকে লক্ষ রাখছি। এই চেয়ারটায় বসে সুবিধা হয়েছে, কে যাচ্ছে, কে আসছে— সব নজর রাখতে পারছি।

জিনিসটা কখনো ফেরত দেব বলে ভাবিনি। সেবার ছোটো ভাই মিজানের বিয়েতে নতুন বউয়ের জন্য গয়না দেবে বলে দাদি বাক্সটা খুলেছিল। বড়ো ভাবি ঝাপটাটা হাতে নিয়ে আবদারের সুরে বলেছিল, সে বিয়ের অনুষ্ঠানে পরবে ওটা। তখন আমিও সীতাহারটা চেয়ে নিয়েছিলাম। দাদি বাক্সটা সরাবার সময় রতনচূড়টা যে শাড়ির ভাঁজে রয়ে গিয়েছিল সেটা কেউ লক্ষ করেনি।

এই ঘটনার পর কম করে হলেও পাঁচ বছর কেটে গেছে। আমি নিজেও আর হাত দিইনি ওটায়। বাক্স বন্দি করে রেখে দিয়েছিলাম। এতদিন পর ছোটো ননদের বিয়েতে শখ করে এবং সাহস করে একবার পরলেও ফেসবুকে শান্তি মতো ছবি দিতে পারিনি। এ বাড়ির কেউ দেখে ফেললে বিপদ হতো। সঙ্গে করে এনেছি বলেও স্বস্তি পাচ্ছি না কিছুতে। ব্যাগে তালা মেরে রেখেছি, কেউ হাত দেবার ভয়ে।

আসলে গত সপ্তাহে বড়ো ভাবি ফোন করে দাদির খবরটা দেবার পর আমি না এসে পারলাম না। ভাবি কথায় কথায় বলল, দাদি নাকি আবোলতাবোল কথার ফাঁকে একবার রতনচূড়টার কথাও বলছিল। তাই আসার আগে ব্যাগে ভরেছি ওটা।

দাদির কিডনির সমস্যাটা বেসামাল পর্যায়ে চলে গেছে বেশ কিছুদিন ধরে। সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করেও কিছু হচ্ছিল না। তার উপর লবণ-টবন কী সবের যেন ইমব্যালেন্সও হয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে শেষ মুহূর্তের আর দেরি নেই। তাই মনে মনে প্রত্যেকে প্রস্তুত হয়ে আছে।

বিকালের দিকে পরিবেশ একটু শান্ত হলে আমি দাদির ঘরে গেলাম। সকাল থেকে যদিও ভাবছি কথাটা বলব কি বলব না? কারণ যে মানুষটা যেকোনো সময় মারা যাবে, তার আর এইসব বৈষয়িক ব্যাপারে আগ্রহ থাকার কথা নয়। পরের মুহূর্তেই মনে হলো জিনিসটা হারাবার পর দাদি অনেক কান্নাকাটি করেছিল। শখের গয়না হারানোর শোক সামলাতে অনেকদিন লেগেছে তার। আমি গিয়ে বলব, ওটা আমি খুঁজে পেয়েছি। কখন কীভাবে— সেসব এ অবস্থায় শুনতে চাইবার কথা না। জিনিসটা ফিরে পেয়ে দাদী খুব খুশি হবে। ফলে নির্ঘাত চুরির ব্যাপারটা ভুলে যাবে।

দাদির দেখাশোনার জন্য যে মেয়েটা আছে ওকে ঘরের বাইরে পাঠালাম। দাদি তখন আধো ঘুমে। তবু আমার গলা শুনে কী করে যেন বুঝে ফেলল। ‘বনু এদিক আয়’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। মাঝেমাঝে দাদী কী করে যেন কথাগুলো ঠিকঠাক শুনতে পায়। আম্মা বলে সবই নাকি চালাকি, কানে ঠিকমতোই শুনতে পায় বুড়িটা৷ 

আমি তার কানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ও দাদী, কেমন আছো?” 
আমার হাতের ওপর জোরে চাপড় দিয়ে দাদী বলল, “আঁ! কানের কাছে আয়া চিক্কুর দিলি ক্যা!”
আমার মনে হয় আম্মা আসলে ঠিকই বলে।

আমি এবার জরিদার প্যাকেট থেকে রতনচূড়টা বের করে তার হাতের ওপর রাখলাম। দাদির চোখে ছানি থাকলেও সে জিনিসটাকে চোখের কাছে এনে যথাসম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আমি দেখলাম নাকের পাটা দুটো ফুলে যাচ্ছে দাদির, চোখের কোল বেয়ে পানি পড়ছে। আমি এবার ফিসফিস করে বললাম, “কি আচানক কাণ্ড দেখো! জিনিসটা আমার হাতেই এসে পড়ল! আমি দেখা মাত্রই চিনছি!”

দাদি আমাকে অবাক করে দিয়ে হাতের ইশারায় বলল, জিনিসটা যেন আমিই রেখে দিই। কিছুক্ষণ জোরাজুরি করলাম আমি। দাদি কয়েকবার ডানে বামে মাথা নাড়ল। অবশ্য আমার বলার ভঙ্গিতেও তেমন জোর ছিল না। তাহলে আর কী! ব্যাপারটা সুন্দরভাবে মিটে গেল!

আমি দেখলাম দাদি তখনো কাঁদছে। সহজ সরল মানুষটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমার অনেকদিন পর তার জন্য খুব মায়া লাগল। নিজের বেতনের টাকা অল্প অল্প করে জমিয়ে দাদা তাকে গয়নাটা উপহার দিয়েছিলেন— এই গল্প কত শতবার যে শুনেছি আমরা! এতদিন পর আমার মনে হলো, সেদিন জিনিসটা সরিয়ে ফেলে কাজটা আমি মোটেও ভালো করিনি। নিজেকে সংযত করা উচিত ছিল আমার। অন্তত বিয়ের অনুষ্ঠানের পর ফেরত দেয়া যেত ওটা।

যা হোক, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর যখন দাদির ঘরে সবার ডাক পড়ল তখন আমার এসব ভাবনা পুরোপুরি উবে গেল৷ বড়ো ভাবি গয়নার বাক্স খুলে বসতেই দাদি একে একে সমস্ত গয়না তার পৌত্র-পৌত্রীদের মাঝে ভাগ করে দিল। আমি তার হাত নাড়বার ভঙ্গি দেখতে দেখতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার দিকে সেরকম কোনো ইশারা করল না দাদি। একে একে টায়রা, ঝুমকা, সীতাহার, মানতাসা, টিকলি, কানপাশা সব ভাগ হয়ে গেল। এখনো আমার ঘরে ছেলেপুলে হয়নি বলে গয়নার ভাগ পেলাম না আমি।

পরদিন ভোরবেলা যখন আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল তখন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একবার দুইবার তিনবার শব্দ হবার পর ঘুম ঘুম চোখেই কান্নাটা শুনতে পেলাম। তখুনিই বিছানা ছেড়ে না উঠে নড়েচড়ে দেয়ালের দিকে ফিরে শুলাম আমি।

কালকের ঘটনাটা ভাবছি। দাদি রতনচূড়টা ফিরিয়ে দেবার পর ওটাকে এনে ব্যাগে তালা বন্দি করে রেখেছি। অত সুন্দর কারুকাজের গয়না এমনি এমনি দিয়ে দেবার মতো বোকা নই আমি। আসলে ফেরত দেবার কথা বলে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার মন জিতে নেবার চেষ্টা ছিল। ভেবেছি তার বাদবাকি গয়নার ভাগ থেকে নিশ্চয়ই বঞ্চিত করবে না আমাকে।

ফেসবুকে দেখলাম, সেজো আপার মেয়েরা টিকলি আর ঝুমকা পরেছে। সাজগোজহীন চেহারায় গয়না পরায় কেমন উদ্ভট দেখাচ্ছে ওদের। রাতেই এসব ছবি দিয়েছে আপা। আমি লিখলাম, “আমাদের দাদির শেষ স্মৃতি, যত্ন করে রেখো।” ওদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমার মনে হলো খামাখা রতনচূড়টার কথা বলে ভুলই করেছি। নইলে হয়ত ঐ টিকলি কিংবা সীতাহারটা আমিই পেতাম।