• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২১, ০৩:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৬, ২০২১, ০৬:৩৯ পিএম

সিরাজগঞ্জের বাবলু ও বঙ্গবন্ধু

সিরাজগঞ্জের বাবলু ও বঙ্গবন্ধু

পত্রিকায় পাতায় খবরটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠল বাবলু— ‘এবার! শেখ মুজিবুর রহমানকে তো আর আটকে রাখতে পারল না।’
তারপর আবার প্রথম থেকে শব্দ করে পড়তে শুরু করল খবরটা—
‘ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার: মুজিবসহ সকলের মুক্তিলাভ: কারাগার রাজবন্দী শূন্য
পূর্ব বাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিল কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে। জনতার জয় হইয়াছে। গণদাবীর নিকট নতি স্বীকার করিয়া দোর্দণ্ড প্রতাপ সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিয়া পূর্ব বাংলার অগ্নিসন্তান, দেশগৌরব আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই মামলায় অভিযুক্ত সকলকেই কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনির বন্দীনিবাস হইতে গতকাল (শনিবার) মধ্যাহ্নে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছেন।
....প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, গত শনিবারে কুর্মিটোলায় সার্জেন্ট জহুরুল হক গুলীবিদ্ধ হইয়া নিহত হওয়ার পর আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে যে প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণ হয়, তাহার ধারাক্রমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাসহ রাজশাহীতে ২ জন, ঢাকায় ৫ জন, নোয়াখালীতে প্রাথমিক স্কুল ছাত্রসহ ৩ জন, কুষ্টিয়ায় ১ জন, খুলনায় ৮ জন ও পাবনায় ২ জন অধিকার সচেতন ছাত্র, শিক্ষক ও মেহনতী মানুষকে প্রাণ দিতে হইয়াছে।...
(দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯)

কিন্তু আজ তো ২৪ ফেব্রুয়ারি! ওদের ওখানে পত্রিকা আসে এক দিন পর। আর সে কারণেই ২৩ ফেব্রুয়ারির খবর ও পেয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি।
এরপর যে-ই খবরের বাকি অংশটা পড়তে যাবে, অমনি হাঁকডাক করতে করতে নানা এলেন। বাবলুর নানা এমদাদুল হক তালুকদার। খুব পরহেজগার মানুষ। বাংলার প্রায় সব নামকরা আলেমের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর লেখা প্রায় সব কবিতা তাঁর মুখস্থ।
নানাকে দেখে খুশি হয়ে গেল বাবলু। বলল, ‘খবর শুনেছেন নানা? শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর মুক্তির জন্য কত কিছুই না করেছি।’ 
নানা মুচকি হেসে বললেন, ‘হুঁ। এটা তো পুরোনো খবর। পরের খবরটা জানো?’
অবাক হলো বাবলু। চোখ দুটো কপালে তুলে দিয়ে বলল, ‘পরের খবর! শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার গ্রেপ্তার করেছে নাকি?’
নানা বললেন, ‘না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফেঁসে গিয়ে ওদের সাহস এখন তলানিতে। নতুন করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার সাহস ওদের নেই।’
অবাক হলো বাবলু, ‘বঙ্গবন্ধু!’
মুখে সেই মুচকি হাসিটা ধরে রেখে নানা বললেন, ‘গতকাল শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে তিনি আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু’।
বঙ্গবন্ধু! বঙ্গবন্ধু শব্দটা শোনার পরই কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল বাবলু। উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। সামনে তখন দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ। সেই মাঠ থেকে হু হু করে বসন্তের বাতাস উড়ে আসছিল। আর ততই উদাস হয়ে যাচ্ছিল বাবলু।
নানাজান খেয়াল করলেন। বাবলুর মাথায় একটা টোকা দিলেন। বললেন, ‘কী হয়েছে লিডার! এত উদাস কেন?’
‘নানাজান, আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যাব।’
এবার নানার চোখ দুটো উঠে গেল কপালে। ‘কী বললে?’
‘বঙ্গবন্ধুর জন্য আমরা সবাই এত আন্দোলন করলাম, এত ছুটোছুটি করলাম, চোখের পানি ফেললাম, নামাজ পড়ে দোয়া করলাম—তিনি এখন মুক্ত হয়েছেন। তাঁকে নিজের চোখে একটিবার দেখব না!’
নানা বললেন, ‘তাঁকে দেখতে যাওয়া তো অনেক ঝক্কির ব্যাপার। এখান থেকে ঢাকা যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা!’
‘আমি যেতে পারব। তাঁকে না দেখা পর্যন্ত আমার ছটফটানি থামবে না। আমি যাবই।’

২.
এই মানুষটার মুক্তির জন্য এত দিন তামাই কাঁপিয়ে রেখেছিল বাবলু। সেই ১৯৬৬ সালে যখন ছয় দফা দিলেন মানুষটা, তখন ওর বয়স আর কত ছিল। বারো বছর। ও তখন তামাই হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন থেকেই তাঁর প্রতি ওর ভালোবাসা জন্মেছে। বাংলার মানুষের জন্যই তো তাঁর ছয় দফা। এ ছয় দফা দেওয়ার কারণেই তো তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো। তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু পূর্ব বাংলার অগণিত মানুষের ভালোবাসার টানে কোনো বাধাই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি।
নানার কাছে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সোলতান পত্রিকার কপি আছে। অর্ধসাপ্তাহিক ওই পত্রিকা পড়ে ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতনতা তৈরি হয়েছে ওর। এ ছাড়া রেডিওর খবর তো আছেই। ওদের গ্রামে কলেজে পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্র আছে। তাদের মুখে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও প্রথম শোনে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজও পড়ে। অবহেলিত বাংলার মানুষের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের কষ্ট, পরিশ্রম ও উদ্যোগ দেখে তাঁর ভক্ত হয়ে যায় ও। তাঁকে দেখতে যেতেই হবে। কিন্তু...
বাবলু জানে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় থাকেন। ঢাকার ধানমন্ডিতে। জীবনে কখনো ঢাকায় যায়নি ও। আচ্ছা, ধানমন্ডি ঢাকার কোন দিকে? ধ্যাৎ। ধানমন্ডি ঢাকার যেদিকেই হোক, ঢাকায় যেতে তো অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে। যাওয়ার কষ্ট ও সয়ে নিতে পারবে। কিন্তু খরচ?
খরচের কথা ভাবতেই মনটা আরও উদাস হয়ে যায় বাবলুর।
বাবলুর বাবা বেশ সচ্ছল মানুষ। ওদের এই তামাই গ্রাম অন্য গ্রামের মতো নয়। এ গ্রামের প্রায় সবাই ধনী। রংপুরে বাবার কাপড়ের ব্যবসা আছে। নিয়মিত রংপুর যাতায়াত করেন তিনি। বাবার কাছে বললে কি ওকে ঢাকা যেতে দেবেন? কে জানে। দিতেও পারেন, আবার না-ও দিতে পারেন। যদি যেতে না দেন, তাহলেই সর্বনাশ। তার চেয়ে বরং হুট করে ঢাকায় চলে গেলে কী আর হবে! কিন্তু খরচ?

৩.
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ২৯ এপ্রিল ১৯৬৯। বিকেল চারটা। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার তামাই গ্রাম থেকে ঢাকার পথে বেরিয়ে পড়ল বাবলু। চলে এলো জামতৈল রেলস্টেশনে। এখান থেকে বিকেল পাঁচটার রাজশাহী মেইল ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জ ঘাটে এলো। সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে স্টিমারে করে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে এসে রাত একটায় ট্রেনে চড়ে বসল বাবলু। এবার সরাসরি ঢাকা।
ঢাকায় তিন-চার দিন থাকতে হবে। রাতে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। হোটেলে খেতে হবে। বাবলু হিসাব করে দেখল সব মিলিয়ে কমপক্ষে ২৫ টাকা খরচ হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পুলিশ কনস্টেবলদের মাসিক বেতন ৩০ টাকা। তার মানে ওর ঢাকায় যাওয়া-আসার খরচ একজন চাকরিজীবীর এক মাসের বেতনের সমান। দুই মাস ধরে অনেক কষ্টে ২৫ টাকা জমিয়েছে বাবলু।
তবে বঙ্গবন্ধুকে দেখার আশায় সে কষ্টটা গায়ে মাখল না। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাওয়ার আনন্দে মনটা ভরে উঠল। ট্রেনের ছন্দময় শব্দে চোখের সামনে ভেসে উঠল বঙ্গবন্ধুর চেহারা। ছবিতে যেমন দেখেছে। বঙ্গবন্ধুর চোখে চশমা, মুখে পাইপ। গায়ে মুজিব কোট। সে কোটে ছয়টা বোতাম। ছয় দফা। হঠাৎ ছবির বঙ্গবন্ধু যেন জীবন্ত হয়ে উঠলেন। ওকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। বঙ্গবন্ধু ওকে ডাকছেন! বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাবলু। তারপর বঙ্গবন্ধু যে-ই ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে যাবেন, অমনি ট্রেনের দুলুনি থেমে গেল। বাবলুর সুন্দর স্বপ্নটাও ভেঙে গেল। চোখ মেলে বাইরে তাকাল। হইচই চিৎকার চেঁচামেচি। ঢাকা! 
রেলস্টেশনের ঘড়ির দিকে তাকাল বাবলু। সকাল আটটা। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে আশপাশে চোখ বোলাল।
দীর্ঘ যাত্রায় খুব ক্লান্ত লাগছে। এখন দরকার ঘুম। রেলস্টেশনের কাছেই একটা হোটেল চোখে পড়ল—হোটেল হানিফিয়া। একটা সিঙ্গেল সিট ভাড়া করল বাবলু। ভাড়া দৈনিক তিন টাকা। 
পরদিন ১ মে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গেল বাবলু। কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিল। তারপর এসে দাঁড়াল হানিফিয়া হোটেলের সামনে। আজ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে ও। ওই তো একটা রিকশা। হাঁক দিল বাবলু, ‘অ্যাই রিকশা যাবেন?’
‘কোথায়?’
‘ধানমন্ডি।’
‘ধানমন্ডির কোথায়?’
এবার আটকে গেল বাবলু। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ধানমন্ডি, এ পর্যন্ত ও জানে। কিন্তু ধানমন্ডির কোথায়—এটা তো জানে না।
আবারও জানতে চাইল রিকশাওয়ালা, ‘ধানমন্ডির কোথায় যাবেন?’
‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। চেনেন?’
চওড়া হাসি ফুটে উঠল রিকশাওয়ালার ঠোঁটে। হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ি! চিনি তো।’
বাবলুর মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তাহলে চলেন।’
বলেই রিকশায় যে-ই উঠতে যাবে, অমনি রিকশাওয়ালা বাগড়া বাধিয়ে দিল, ‘আগে ভাড়া ঠিক করে নেন। এত সকালে ওদিকে গেলে ভাড়া পাই কিনা ঠিক নেই। বেশি ভাড়া দিতে হবে। দিবেন?’
‘ঠিক আছে, বেশি ভাড়াই দিবো।’ 
এবার বাবলুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপল রিকশাওয়ালা। তার চোখে অবিশ্বাস! এ রকম যাত্রী সচরাচর মেলে না। ভাড়া নিয়ে দরদাম করে সবাই। কিন্তু এ তো দেখছি সবকিছুতেই রাজি হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ঢাকায় নতুন এসেছে। নিশ্চিত হতে চাইল রিকশাওয়ালা, ‘যা ভাড়া চাই তাই দিবেন তো?’
বাবলুর মন ছটফট করছিল। চোখ দুটো বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সামান্য এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করতে ইচ্ছে করছে না। চটজলদি বলল, ‘হ্যাঁ দিবো।’
‘ঠিক তো!’
‘ঠিক।’
‘পাক্কা এক টাকা ভাড়া দিতে হবে।’
এবার লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে বসল বাবলু। তারপর বলল, ‘আমি রাজি। এবার চলেন।’
ভীষণ খুশি হলো রিকশাওয়ালা। এক টাকা ভাড়া! বাবলুও ভীষণ খুশি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে। খুব জোরে প্যাডেল মারতে লাগল রিকশাওয়ালা। দ্রুত বেগে ধানমন্ডির দিকে ছুটে চলল রিকশা। রাস্তার দুই পাশে চোখ বুলিয়ে ঠিকমতো কিছুই দেখতে পারছে না বাবলু। রিকশার গতির কারণে ভীষণ বেগে সরে যেতে লাগল দুপাশের সবকিছু। তা ছাড়া তখন সকালও হয়নি। ভোর পেরিয়ে সকাল কেবল হব হব করছিল।
সকাল হওয়ার আগেই তেমনি এক সময় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এক বাসার সামনে এসে থামল রিকশা। বাসার দিকে ইঙ্গিত করে রিকশাওয়ালা বলল, ‘ওই যে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।’
বাড়ির দিকে তাকাল বাবলু। ছিমছাম দোতলা বাড়ি। বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। হঠাৎ রিকশাওয়ালার ডাকে সংবিৎ ফিরল, ‘এবার ভাড়াটা দেন!’
পকেট থেকে দুটো আধুলি বের করে রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিল বাবলু। ভাড়া পেয়ে আর দেরি করল না রিকশাওয়ালা। সাঁই সাঁই করে চলে গেল।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে এলো ও। বাইরে থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাড়ি দেখতে লাগল।
দোতলা বাড়ি। বাবলু শুনেছে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় তলায় থাকেন। দ্বিতীয় তলার কোন রুমে থাকেন!
বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ওপর দিয়ে এবার নিচতলায় চোখ বোলাল। গাড়ি বারান্দায় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি বঙ্গবন্ধুর গাড়ি? জানে না বাবলু।
পুরো বাড়ি নিশ্চুপ। বাইরে থেকে লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল বাবলু। লেকের পাশ থেকে ঘুরে এলো। তারপর আবার তাকাল বাড়ির দিকে। সেই কখন এসেছে! এক ঘণ্টা তো হয়েছেই। বাড়ির ভেতরে বা বাইরে এখনো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আসলে খুব বেশি ভোরে চলে এসেছে ও।
হঠাৎ বাড়ির গেটে কাউকে দেখতে পেল বাবলু। আর দেখেই ছুটে গেল। সালাম জানাল লোকটিকে, ‘আসসালামু আলাইকুম!’
‘ওআলাইকুম আসসালাম। কে আপনি?’
কী মনে করে লোকটিকে মামা সম্বোধন করে ফেলল বাবলু। বলল, ‘মামু, আমি সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছি।’
‘সিরাজগঞ্জের কোন জায়গায় বাড়ি আপনার?’
‘বেলকুচি থানা। গ্রামের নাম তামাই।’
লোকটিও নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আমার নাম আকরাম হোসেন বাবু।’
‘তাহলে আপনি আমার বাবু মামু। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
মাথা নাড়লেন বাবু মামু। বললেন, ‘সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানা। গ্রামের নাম তামাই। খুব ভালো। বাবার নাম?’
‘বাবার নাম আব্দুল মন্নাফ খান। দাদার নাম আব্দুল খান। আর আমার দাদার বাবার নাম বৈরাম খান। তিনি বিরাট এক বাঘের সঙ্গে একা লড়াই করেছিলেন। একটি পিতলের বদনা দিয়ে বাঘের মাথায় বাড়ি মেরেছিলেন।’
বাবু মামু হেসে ফেললেন। বললেন, ‘তাহলে তো ভীষণ দুঃসাহসী ছিলেন আপনার বড় আব্বা।’
‘জি। আমারও অনেক সাহস।’
মজা পেলেন বাবু মামু। মুচকি হেসে জানতে চাইলেন, ‘আপনার কোনো দুঃসাহসী কাজের রেকর্ড নেই?’
‘আছে। আমি এখনো স্কুলে পড়ি। তামাই হাইস্কুলে ক্লাস নাইনের ছাত্র। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী আমি। ছাত্র গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের তামাই ফুটবল খেলার মাঠে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বিরাট ছাত্র জনসভা হয়েছিল। আমি ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছি।’
বাবু মামুর মুখে আর সেই হাসিটা নেই। তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন বাবলুর দিকে। বড্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেল বাবলু। ওর ওপর থেকে বাবু মামুর চোখ সরছেই না। আবার বলল, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। দেখা করা যাবে?’
এবার গম্ভীর কণ্ঠে বাবু মামু বললেন, ‘দেখা করতে পারবেন, অপেক্ষা করেন। দেরি হবে।’ 
অপেক্ষা করতে থাকে বাবলু। অপেক্ষার সময় শেষ হতে চায় না। তার ওপর কত দিনের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করবে। এত কষ্ট করে ঢাকায় এসেছে। এখন সামান্য অপেক্ষাও অসহ্য লাগছে। 
একটু পর আবারও তাড়া দিল বাবলু, ‘বাবু মামু, আরও দেরি হবে?’
বাবু মামু বললেন, ‘আসেন ভিতরে এসে বসেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে আপনার কথা বলে আসছি।’
বলেই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন বাবু মামু।
আবারও অপেক্ষা করতে থাকে বাবলু। আর নানা কিছু ভাবতে লাগল। শহুরে মানুষের জীবন-যাপন পদ্ধতি আসলে ওর জানা নেই। গ্রামে ওরা যেমন খুব ভোরে উঠে যায়, শহরের মানুষ এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠে না। কিংবা হয়তো বঙ্গবন্ধু খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছেন ঠিকই, কিন্তু এত ভোরে কারও সঙ্গে দেখা করেন না! 
হঠাৎ চমকে উঠল বাবলু। আরে! কে ইনি? পত্রিকার পাতায় তো এঁকে দেখেছে ও। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ইনিও এসেছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম! আর ওই তো তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান!
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এসে সবাইকে এভাবে দেখার সৌভাগ্য হবে, ভাবেনি ও। 
জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি আরও অনেক নেতাও চলে এসেছেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। নেতাদের সঙ্গে অনেক কর্মীও আছেন।
সময় যত গড়াতে লাগল, ভিড় তত বাড়তে লাগল। অনেকের আলাপ-আলোচনা শুনে বাবলু বুঝতে পারল, ওর মতো অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখতে এসেছে। এর মধ্যে অনেক সাধারণ মানুষও আছে।
ঘড়ির দিকে তাকাল বাবলু। সাড়ে আটটা। আর তখনই হঠাৎ বিশাল এক মানুষের পায়ের শব্দ পেল সিঁড়িতে। বঙ্গবন্ধু!
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জোরে জোরে হাঁক দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, ‘সিরাজগঞ্জের বাবলু কে? সিরাজগঞ্জের বাবলু কে?’
বাবলুর হৃদযন্ত্র লাফিয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধুর মুখে ওর নাম! দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে ওর। বসা থেকে চট করে উঠে দাঁড়াল বাবলু। তারপর ছুটে এগিয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি।’
হাত বাড়িয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু। হ্যান্ডশেক করার জন্য ওর দিকে বঙ্গবন্ধু হাত বাড়িয়েছেন! এবারও ধাক্কা খেল বাবলু। ধাক্কা সামলে ডান হাত বাড়িয়ে দিল বঙ্গবন্ধুর দিকে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশাল হাতের ভিতর পুরে ফেললেন কিশোর বাবলুর হাতখানা। তারপর কিছুক্ষণ জোরে জোরে ঝাঁকি দিলেন।
হাত ছাড়িয়ে এবার বাবলুর দুই গালে আলতো করে আদুরে চাপড় দিলেন। তারপর বাবলুর মাথায় হাত রাখলেন বঙ্গবন্ধু। ডান হাত দিয়ে বাবলুর মাথা বোলাতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতের ছোঁয়া ওর মাথায়! এখানে লোকজন না থাকলে হয়তো শব্দ করে কেঁদে ফেলত বাবলু। অনেক কষ্টে সে কান্না থামাল। চোখ দুটো তো অনেক আগেই ভিজে গিয়েছে।
মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন ওর বাবার নাম, কী করে, কয় ভাইবোন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথার জবাব দিল ও। আর প্রতিটি জবাব ওর গলা দিয়ে বেরোল কাঁপতে কাঁপতে। বঙ্গবন্ধুও ওর প্রতিটি জবাব শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। ওদিকে বঙ্গবন্ধুর ভীষণ তাড়া। অনেক নেতা-কর্মী বসে আছে তাঁর অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ঠিক আছে বাবলু, আবার দেখা হবে।’
বলেই অপেক্ষায় থাকা শখানেক নেতা-কর্মীদের দিকে এগিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। বাবলু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল বঙ্গবন্ধুর দিকে। প্রত্যেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে হাত মেলালেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তারপর গাড়িতে উঠলেন। তাঁর সঙ্গে নেতারাও গাড়িতে উঠলেন।
সেদিন ছিল ১৯৬৯ সালের ১ মে। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের প্রথম ঘরোয়া রাজনৈতিক মিটিং। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল বগুড়ার উদ্দেশে।

সূত্র : ১৯৭১ ও অনেক অজানা কথা—আবু মোহাম্মদ খান (বাবলু)