• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২১, ০৮:৪৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ১৭, ২০২১, ০৯:২৭ এএম

ইয়াহিয়া খানের আলোচনার খোলসে প্রতারণা

ইয়াহিয়া খানের আলোচনার খোলসে প্রতারণা

১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফলাফল দেখে বেকুব বনে যান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এ ফলাফল ছিল ইয়াহিয়া খান ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত জেনারেলদের কাছে বজ্রাহতের মতো। আওয়ামী লীগ যে এতটা আসন নিয়ে বিজয়ী হবে, তা ছিল তাদের কাছে কল্পনাতীত। এ ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সম্মুখে দাঁড়ায়, তা হলো ইয়াহিয়া খান কেন আইয়ুব খানের পতনের পর ‘একমাথা এক ভোট’ ব্যবস্থা প্রবর্তনে সম্মত হয়ে নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন? আপাত বিচারে মনে হতে পারে তিনি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে এ ধরনের ওজনদার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই এ ধরনের উদ্যোগের অসারতা ও প্রতারণার দিকটি খোলাসা হয়ে পড়ে। বাস্তবতা হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমতা ও বাঙালিদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে কখনো প্রসন্ন ছিলেন না। সর্বোতভাবে তারা বাঙালি জাতিকে একটি শোষিত জাতি হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তাদের যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ছিল না, তেমনি বাঙালি জাতির প্রতিও কোনো ভ্রাতৃত্বমূলক দায় ছিল না। নৃতাত্ত্বিকভাবে নিজেদের সুপিরিয়র মনে করে ইনফেরিয়র (তাদের মতে) বাঙালির দ্বারা শাসিত হতেও তারা কখনো মানসিকভাবে ছিল না। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান মনে করতেন; শীতাঞ্চলের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এ অঞ্চলের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। বাঙালিদের প্রতিও তার মনোভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। ক্ষমতাচ্যুতির প্রাক্কালে বিধি মোতাবেক আইন পরিষদের স্পিকার আবদুল জব্বার খানের (বরিশালের সন্তান আবদুল জব্বার খান ১৯৬২ সালে বিচার বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণের পর পাকিস্তান মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের রাজনৈতিক দল ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’ (কনভেনশন)-এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হন। ১৯৬৫ সালে বরিশাল থেকে নির্বাচিত হয়ে ১০ জুনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন) সমীপে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান থাকলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে; বাঙালি হওয়ার কারণে স্পিকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ না করে ক্ষমতা তুলে দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে। সে সময় ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্পিকার আবদুল জব্বার খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি উত্থাপিত হলে; জেনারেল আইয়ুব দাম্ভিক কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আই ডু নট ট্রাস্ট দ্য বাস্টার্ড।’ আইয়ুবের রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল হয়েও স্পিকার সাহেব বাঙালি হওয়ার কারণে তার প্রভুর কাছে বেজন্মা বলেই অপাঙক্তেয়ও হয়েছিলেন। একই কারণে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আইয়ুব খান চিকিৎসা বা অন্য কোনো সফরে বিদেশে অবস্থাকালেও কখনো স্পিকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে যেতেন না।

বাঙালিদের প্রতি এহেন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আইয়ুব খানেরই নয়, একই প্রজন্মের পশ্চিমা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেও পুরোমাত্রায় বহাল ছিল, অতঃপর সত্তরের নির্বাচনে বিপর্যস্ত হওয়ার পর জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ ক্ষমতা বলয়ের আমলা, মুৎসুদ্দি, ভূস্বামী, শিল্পপতিরাও তাদের সঙ্গে একাট্টা হয়েছিল। গ্রহণ করেছিল ধ্বংসাত্মক নীতি। এক্ষেত্রে ১৯৫৪-১৯৫৮ কালপর্বে পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক নিস্পৃহতাজনিত অভিজ্ঞতাও শাসকগোষ্ঠীকে বেপরোয়া ভাবনার জন্য জুগিয়েছিল কার্যকর খোরাক। সে সময় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের (মোট আসন ৩০৯টি) মধ্যে ২৩৭টিতে জয়ী হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। তন্মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ বিজিত হয়েছিল ১৪৩টি আসনে। পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসনে বিজিত হয়ে চিরতরে বাংলার মাটি থেকে উৎপাটিত হয়েছিল। অতঃপর বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে ৩ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে গঠিত এ কে ফজলুল হকের গণতান্ত্রিক সরকারকে ৩১ মে (মতান্তরে ৩০ মে) ৯২ (ক) ধারা জারির মাধ্যমে বরখাস্ত করা হয়। সে সময় ষড়যন্ত্রমূলক আদমজী দাঙ্গাকে উপজীব্য করে অন্যায়ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা হলেও পূর্ব বাংলার নেতা-কর্মী বা জনগণের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিবাদ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও ৩০ জন আইনপরিষদ সদস্যসহ বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে আটক করা হলেও গড়ে ওঠেনি কোনো ধরনের প্রতিরোধ। একমাত্র আতাউর রহমান খান কয়েক দিন পরে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব খালাস করেছিলেন। এ ধরনের নিস্পৃহতার সুযোগে পশ্চিমারা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী, দাঙ্গাকারী অভিধায় অভিযুক্ত করার অবকাশ পেয়েছিল। এহেন প্রতিবাদহীনতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী। তারা এ জাতিকে ভীরু-কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস গ্রহণেও উৎসাহিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে একই ধারাক্রমে যুক্তফ্রন্টের তৃতীয় মন্ত্রিসভাকে (আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন এ মন্ত্রিসভা ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হতে ৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল ছিল) বরখাস্তের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমাধিস্থ করে সামরিক আইন জারি করারও সাহস পেয়েছিল।

উপরিউক্ত ক্ষেত্রের নিস্পৃহতা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধহীনতায় কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘শতকরা সাতানব্বই ভাগ জনসাধারণ যেখানে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিল ও সমর্থন করল, শত প্রলোভন ও অত্যাচারকে তারা ভ্রুক্ষেপ করল না—সেই জনগণ নীরব দর্শকের মত তাকিয়ে রইল। কি করা দরকার বা কি করতে হবে, এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করা উচিত হবে কি না, এ সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ একদম চুপচাপ।’ একই প্রসঙ্গে আলোকপাতকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর পর্যবেক্ষণে একই গ্রন্থে আরও লিখেছেন, ‘এর ফল হল ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যে, যতই হৈচৈ বাঙালিরা করুক না কেন, আর যতই জনসমর্থন থাকুক না কেন, এদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। পুলিশের বন্দুক ও লাঠি দেখলে এরা পালিয়ে গর্তে লুকাবে। এই সময় যদি বাধা পেত হবে হাজারবার চিন্তা করত বাঙালিদের উপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে।’ বঙ্গবন্ধুর এ ধরনের পর্যবেক্ষণ নির্মম সত্য হয়ে আমাদের সমুখে উপস্থিত হয়েছিল পরবর্তী সময়ের আইয়ুবীয় ও ইয়াহিয়ার শাসনামলে। আইয়ুব খানকে পুরোটা সময় টিকে থাকতে হয়েছে দমন-পীড়নের মাধ্যমে। অতঃপর বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছে গদি। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো অবাধ নির্বাচন দিয়ে একটি অসাধারণ কাজ করেছিলেন, কিন্তু নির্বাচনের পর পাকিস্তানি রুলিং এলিটদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে গিয়ে তাকেও অনুসরণ করতে হয়েছে পূর্ববর্তীদের পদাঙ্ক। পরিণতিতে সমাধিস্থ করতে হয়েছে পাকিস্তানের তথাকথিত জাতীয় সংহতি-অখণ্ডতা।

সে সময় জনসংখ্যার নিরিখে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ-শতকরা ৫৪ ভাগ। চলমান আঞ্চলিক বৈষম্য, শাসন-শোষণ হতে উত্তরণের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি। এহেন অবস্থায় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ যে ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মতো একচেটিয়া বিজয় অর্জনে সক্ষম হবে, এমনতর সম্ভাবনাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। তদুপরি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মতোপ একজন উর্দিধারী কেন সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে অনুৎসাহী হননি, তা গভীরভাবে ভাবার বিষয়। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ক অনেক তথ্য-উপাত্ত উদঘাটিত হয়েছে, যাতে স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নয় বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের সদিচ্ছায় নয়, পশ্চিমাদের স্বৈরশাসনকে পোক্ত করার সুদূরপ্রসারী এক কুমতলব নিয়ে পাকিস্তানি রুলিং এলিটদের প্রতিভূ হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী ফলাফল যা-ই হোক না কেন, বাঙালিরা যে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থান গড়ে তুলতে পারবে না, সে বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই ইয়াহিয়া খান নির্বাচনে নেমেছিলেন। ইয়াহিয়া খানের এহেন ভাবনার মূলে ছিল: (ক) পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট। যে রিপোর্টে বলা হয়েছিল; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৭ শতাংশ আসনে জয়লাভে সক্ষম হবে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অবস্থানও থাকবে আওয়ামী লীগের কাছাকাছি। অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ আসন ভাগাভাগি হবে অন্যান্য ছোট আকারের রাজনৈতিক দলের মধ্যে। (খ) আওয়ামী লীগ খোলা মাঠ পেলেও ইয়াহিয়া খানের প্রতি অনুগত থাকবে। (গ) লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার: ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইয়াহিয়া খানের জারিকৃত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের আলোকে। এ আদেশে ইসলামি মূল্যবোধ সংরক্ষণ ব্যতিরেকে সংবিধান প্রণয়নের অবকাশ ছিল না। এছাড়া ওই আদেশের ২৫ ও ২৭ অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্টের হাতে সংবিধানবিষয়ক সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষিত রাখা হয়। অনুচ্ছেদ দুটিতে বলা হয়েছিল; সাংবিধানিক পরিষদ কর্তৃক যে সংবিধানই প্রণয়ন করা হোক না কেন, তা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অথেন্টিকেটেড হতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলে প্রণীত সংবিধান বাতিলও করতে পারবে। অধিকন্তু প্রেসিডেন্টের গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে না। (ঘ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনের দুমাস পূর্বে অক্টোবরে জাতিসংঘের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নিক্সন সে সময় নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে; ইয়াহিয়া আত্মপ্রত্যয়ের সাথে জানিয়েছিলেন; নির্বাচনে কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অধিকন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের উন্মেষ ঘটবে, যারা অনবরত পারস্পরিক কোন্দলে লিপ্ত থাকবে। এর ফলে প্রেসিডেন্টের অবস্থান বিপর্যস্ত হবে না, প্রেসিডেন্ট পূর্বের মতো পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুখ্য নিয়ামক হিসেবে বহাল থাকবে। ইয়াহিয়া খানের এ ধরনের সাফাইয়ে নিক্সন ও কিসিঞ্জার প্রীত হয়ে পাকিস্তানকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সহায়তাদানের কথা ব্যক্ত করেছিলেন।

এ সমস্ত নিরাপত্তা কবচ হাতে রেখেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন। হিতাকাঙ্ক্ষী জেনারেলরা অবুঝের মতো নির্বাচনের আয়োজন করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি উপরোক্ত কৌশলের ওপর ভরসা করে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। অতঃপর নির্বাচনী ফলাফল দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন ইয়াহিয়া খান। আওয়ামী লীগের বাঁধভাঙা বিজয় ইয়াহিয়াসহ পাকিস্তানি শাসকচক্রের সমস্ত হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দেয়। দিশেহারা হয়ে তারা বাঙালিদের উত্থান ঠেকাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যেকোনো মূল্যে নিজেদের প্রাধান্য অটুট রাখার স্বার্থে যেকোনো পন্থা অবলম্বনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এ পর্যায়ে রুলিং এলিটদের প্রতিনিধি হিসেবে ইয়াহিয়ার সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার অনতিকাল পরেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছয় দফার আলোকে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণ ও তৎপরবর্তী করণীয় সম্পর্কেও গ্রহণ করা হয় কার্যকর পদক্ষেপ। মুখ্যত ছয় দফার আলোকে সংবিধান প্রণীত হলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কাঠামো আপনা-আপনিই দুর্বল হয়ে পড়ত। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রসারিত ও ত্বরান্বিত হতো। সে পথেই বঙ্গবন্ধু উড়িয়েছিলেন নৌকার পাল। এহেন উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে জানুয়ারির ৪ তারিখে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণকে লাখো জনতার উপস্থিতিতে রেসকোর্স ময়দানে শপথ গ্রহণ করানো হয়। সে সময়কার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে ৪ জুন ১৯৭১ সালে ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল; এ সময়ে বাঙালিরা উৎসবমুখর মেজাজে ছিল এবং বিচ্ছিন্নতামুখী কোনো পদক্ষেপও দেখা যায়নি। ২৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানকে ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ বলে অভিহিত করেন এবং সংবিধান পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় বসবে বলে সম্মত হন। বাঙালিরা তাদের ঢাকা শহর ও অ্যাসেম্বলি ভবন সাজাতে শুরু করে এবং এ সময় ঢাকা ছিল খুবই প্রশান্ত।’ 

অতঃপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল পীরজাদাকে সঙ্গে নিয়ে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে আলোচনাও করেন। ১৮ জানুয়ারি; ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে; অচিরেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বলে আভাস দেন। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে সাংবাদিকদের জানান, এ ব্যাপারে শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করুন তিনিই তো ভাবী প্রধানমন্ত্রী। অতঃপর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে মর্মে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার পরপরই দৃশ্যপটে উপস্থিত হন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রকাশ থাকে যে, সে সময় উপজাতি এলাকার জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসনসহ কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের আসনসংখ্যা ছিল ১৩৮টি। তন্মধ্যে ভুট্টো বিজিত হয়েছিলেন ৮৩টি আসনে। বেলুচিস্তান প্রদেশে ভুট্টো পার্টি কোনো আসনে জিততে পারেননি। সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগের অর্ধেক আসন পেলেও পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তিনি ক্ষমতার শরিকানার প্রশ্নে সরব হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি গণতান্ত্রিকতার রীতি মোতাবেক সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পুরো পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন। তার প্রভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই ক্ষমতা দিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বাঙালিরা পশ্চিমাদের দ্বারা ২৩ বছর শাসিত হয়ে বলে এখন তারা পশ্চিমাদের শাসন করবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। একসময় বলেন, ইথার হাম উধার তুম। সর্বোপরি ছয় দফার প্রশ্নে গ্রহণ করেন কঠোর অবস্থান। তার ভাষ্য অনুযায়ী; ছয় দফা মেনে নেওয়া হলে পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এ ধরনের নানামাত্রিক অবান্তর কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমীপে ক্ষমতা হস্তান্তরের পুরো প্রক্রিয়াটিকে অনিশ্চিত করে তোলেন। একই সময় তিনি সামরিক বাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাকে প্রলুব্ধ করে এক মরণঘাতী ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, মুজিব ৬ দফার পক্ষে আপস না করলে তার দল ৩ মার্চের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবে না। এরপর পরই ১৮ ফেব্রুয়ারি এক জনসভায় হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ঢাকা পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের জন্য কসাইখানা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো সদস্য অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের চেষ্টা করলে তার পা ভেঙে দেওয়া হবে। অতঃপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পাখি শিকারের জন্য তার লারকানার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ভুট্টোর বাড়িতে একত্র হন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ, চিফ স্টাফ অফিসার লে. জে. পীরজাদাসহ পদস্থ সামরিক কর্তারা। সেখানেই গৃহীত হয় গণহত্যার প্রথম পরিকল্পনা। অতঃপর ভুট্টোর পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে দাবি জানানো হলে; ইয়াহিয়া খান ১ মার্চে এক ঘোষণা বলে পূর্বনির্ধারিত ৩ মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগতি করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে ২৫ মার্চ আইন পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা চলাকালেই তা ২২ মার্চে বাতিল করা হয়। অতঃপর লোক দেখানো আলোচনার জন্য ভুট্টো দলবল নিয়ে ২১ মার্চে ঢাকায় আগমন করেন এবং ২৫ মার্চে গণহত্যা দর্শন শেষে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ২৬ মার্চে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রকাশ থাকে যে নির্বাচনের ফলাফল দেখে অস্থির চিত্তের উচ্চাভিলাষী জুলফিকার আলী ভুট্টো তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন। পূর্বাঞ্চলের বঙ্গবন্ধুর মতো পশ্চিমাঞ্চলে তার একচেটিয়া সমর্থন ছিল না। এ অবস্থায় তার জন্য পাকিস্তানের গদিতে বসার বাসনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও হয় সুদূরপরাহত। এহেন পরিস্থিতিতে উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য তিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পিঠে ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে বেছে নেন ষড়যন্ত্রের সংকীর্ণ পথ। এ ধরনের ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাকে বঙ্গবন্ধু সতর্কও করেছিলেন। বলেছিলেন, তারা (সামরিক জান্তা) প্রথমে আমাকে হত্যা করবে, অতঃপর আপনাকে হত্যা করবে। কিন্তু ভালো কথা শোনেননি ভুট্টো। পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ বাণীই সত্য হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল।

পাকিস্তানি রুলিং এলিটদের প্রতিভূ ইয়াহিয়া খানও সুধীজনের সুকথা শোনেননি। তিনি শুনেছেন ভুট্টোসহ কট্টরপন্থীদের কুকথা। এ বিষয়ে কানাডার অটোয়া থেকে প্রকাশিত ‘অটোয়া সিটিজেন’ পত্রিকায় ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘সুকথা শোনেননি ইয়াহিয়া’ শিরোনামে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল; পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবেক কমান্ডার ইন চিফ অ্যাডমিরাল এস এম আহসান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অভিযান, অনৈতিক এবং শেষ পর্যন্ত অকার্যকর হবে। এরপর গভর্নর পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লে. জেনারেল ইয়াকুবকেও অনুরূপভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খান উপসামরিক আইন প্রশাসক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর হন। তিনি পরে পদত্যাগ করেন। বিমানবাহিনীর সাবেক কমান্ডার এয়ার মার্শাল আসগর খান ৬ মার্চ বলেন, ‘অবিলম্বে মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। ইয়াহিয়ার কেবিনেটের সাবেক তথ্যমন্ত্রী মেজর জেনারেল শের আলী খান ১২ মার্চ এক তারবার্তায় প্রেসিডেন্টকে এমন কিছু না করার আহ্বান জানান, যা এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিনাশের জন্য দায়ী হয়ে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অভিযানের পাঁচ দিন আগে ২০ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দলগুলো করাচিতে কনভেনশন করে এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত ৪০ জন সদস্য ‘সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি মেনে নেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। (সংশোধিত)। এঁদের কারও কথাই আমলে নেননি মদ্যপ ইয়াহিয়া খান। অধিকন্তু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিদের চিরতরে অবদমনের নিমিত্ত প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সময় ক্ষেপণার্থে চালিয়ে যান লোক দেখানো প্রতারণাপূর্ণ আলোচনা। 

ব্যাপক আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে ১৫ মার্চে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকা উপস্থিত হন ইয়াহিয়া খান। অথচ এর অনেক আগেই ইয়াহিয়া ও তার দোসররা ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে রেখেছিল। এ বিষয়ে সিদ্দিক সালিক ‘নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল’ গ্রন্থে বিস্তারিত ইতিবৃত্ত তুলে ধরছেন। বাঙালিদের অনুকূলে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার বিষয়টি তিনি অবহিত হন ইয়াহিয়ার আস্থাভাজন এক জেনারেলের কাছ থেকে, নির্বাচনের পরপর ডিসেম্বরের শেষ দিকে ওই জেনারেল ঢাকায় এসেছিলেন এবং গভর্নর হাউসের এক পার্টিতে ভোজন শেষে ঘরোয়া আলোচনার সময় বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না...আমাদের ওপর শাসন চালাতে এই কালো জারজদের সুযোগ দেব না।’ এভাবেই নির্বাচনের পরপরই তারা বাঙালিদের কালো জারজ বলে আখ্যায়িত করে ক্ষমতা বলয় হতে দূরে রাখার জন্য ফন্দি-ফিকির করতে খাকে। সে লক্ষ্যেই গ্রহণ করতে থাকে সামরিক প্রস্তুতি। সিদ্দিক সালিক মনে করেন, এসব ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বরাবরই অবহিত ছিলেন। যে কারণে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য তিনি প্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খানকে অভিনন্দন জানালেও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ বাঁশের লাঠি দিয়ে এদের প্রতিহত করবে বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ইতিমধ্যে মার্চের ৩ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দিলেও প্রতারক ইয়াহিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে দমন-পীড়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। সে নিরিখে ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখে গ্রহণ করা হয় অপারেশন ব্লিজের পরিকল্পনা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সৈন্যদের প্রেরণ করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তান হতে সৈন্য আনয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ অপারেশনের মাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীদের আটকের পরিকল্পনা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়।

অতঃপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য গ্রহণ করা হয় কার্যকর পদক্ষেপ। ইতিবাচক মনোভাবাপন্নদের সরিয়ে কুখ্যাতদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসান প্রেসিডেন্টকে শেষবারের মতো বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন যেন ৩ মার্চের নির্ধারিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি মুলতবি করা না হয় কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাতে একমত হননি, উপরন্তু তাঁকে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তদস্থলে নিয়োগ দেওয়া হয় জেনারেল ইয়াকুবকে। পরবর্তী পর্যায়ে জে. ইয়াকুবকেও সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তদস্থলে নিয়োগ দেওয়া হয় ভুট্টোর আস্থাভাজন-বালুচিস্তানের কসাই হিসেবে কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে। পরবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক চলাকালেই নির্দেশিত হয়ে লে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও জেনারেল রাও ফরমান আলী মার্চের ১৮ তারিখে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এরপরও প্রতারক ইয়াহিয়া মার্চের ২২ তারিখেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লোক দেখানো আলোচনা চালিয়ে যান। এর আগে ২১ মার্চে ভুট্টো ঢাকায় উপস্থিত হয়ে একইভাবে প্রতারণামূলক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ও গৃহীত সামরিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আলোকপাত কালে লে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তার ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১ মার্চ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আগেই জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারিতেই ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। ইয়াহিয়া খান, শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে ত্রিপাক্ষিক আপোষরফার আলোচনার উপর এই সিদ্ধান্তটি বিফলতার ছায়া বিস্তার করেছিল।’ ইয়াহিয়া-ভুট্টোর এসব ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু মোটেও অনভিহিত ছিলেন না। যে কারণে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসার দশ দিন পূর্বেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যেকোনো সময় হত্যার শিকার বা গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুই, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে।’

সার্বিকভাবে ৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে দৃকপাত করলে দেখা যায়; প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পাকিস্তানের শাসন কাঠমোভুক্ত জান্তারা কখনো বঙ্গবন্ধুর অনুকূলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ইতিবাচক ছিলেন না। তারা দানবিক প্রক্রিয়ায় বাঙালিদের জাতিগত উত্থান নস্যাৎকরণে তৎপর ছিলেন। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরপরই এ লক্ষ্যে ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। অতঃপর ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকে আটক ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালাবার পরদিন সকালে অফিসার্স মেসে কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আলোচনাকালে তারা মন্তব্য করেছিল; বাঙালিদের ভালো করে এবং ঠিকমতো নিবীর্য করা হয়েছে অন্তত একটি বংশধরের জন্য তো বটেই। সে আলোচনায় যোগ দিয়ে মেজর মালিক বলেছিল; হ্যাঁ, ওরা শুধু শক্তির ভাষাকেই চেনে। ওদের ইতিহাসই এ কথা বলে। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করতে গিয়ে অতঃপর যে বর্বরতার পথ অবলম্বিত হয়েছিল, সে পথে তারা শেষতক কামিয়াব হতে পারেনি। নাকে খত দিয়ে করতে হয়েছিল আত্মসমর্পণ। ভাঙা হৃদয় নিয়ে দেখতে হয়েছিল বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। দেখতে হয়েছিল বাঙালিদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জয়।