বাংলাদেশের মানুষ কবিতার বই কেমন পড়েন কিংবা কিনেন এই বিষয়ে কোন জরিপ আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এদেশে প্রতিবছর অনেক কবিতার বই বের হয়। সে হিসেবে বলা যায় কবিতাপ্রেমী হয়ত বা ভালোই আছেন এদেশে। তবে বাংলাদেশের জন্ম থেকে এ পর্যন্ত আমার চোখে কবিতার অনুবাদ তেমন একটা চোখে পড়েনি। যা কিছু দেখেছি তার বেশির ভাগেরই পুনরায় অনুবাদ দরকার বলে মনে হয়েছে। তাহলে এদেশের কবি ও পাঠক কি অন্য ভাষার কবিতা খুব একটা পড়েন না? আমরা এ প্রশ্ন করতেই পারি, কেন আমাদের কবিরা বিদেশী ভাষার কবিতা তেমন অনুবাদ করেননি? অন্য ভাষার কবিরা কেমন লিখছেন সেটা জানার কি তাদের তেমন দরকার মনে হয়নি? যে ভাষাতেই লেখা হোক, কবিতার একটা স্যাকরেড বা দৈব ভাষা রয়েছে। কবিতার একটা সাধারণ জগৎ রয়েছে। আমাদের কবি ও পাঠক কি বৈশ্বিক সেই জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন? জগতে আমার জানার বাইরেও যে কত সুখপাঠ্য বড় কবি রয়েছেন তা সম্প্রতি সলিমুল্লাহ খান অনূদিত পেন্টি সারিকস্কির কবিতার বই পড়ে জ্ঞান হল।
সারিকস্কি ইউরোপের ছোট্ট দেশ, ফিনল্যান্ডের কবি হলেও তাঁর কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি আমার কথাই হয়ত বলছেন। আমার দুঃখ, বেদনা বা ভালোবাসার কথাই বলছেন। অনুবাদক গ্যেটেকে উল্লেখ করে যথার্থই লিখেছেন, ‘কবিতা মানবজাতির এজমালি সম্পত্তি ভাষার গুনে—এ সত্য সারিকস্কি ভালোই আমল করিয়াছিলেন। এক বিচারক বলিয়াছেন, যবন আর রুমি ভাষার সহিত নতুন আত্মীয়তা রচনা করিয়া তিনি আপনার ভাষায় নতুন জীবন যোগ করিয়াছেন। মফস্বলি বদনাম ঘুচাইয়া সুমি সাহিত্যকে বিশ্বজনীন করিয়া তুলিয়াছেন তিনি—সম্ভবত ইহা তাঁহারই একক সিদ্ধি।’ ( উহারা বাতাসে: ২০২১: ২২)
পেন্টি সারিকস্কির কবিতা পড়তে পড়তে এই কথার সত্যতাই যেন টের পাই। মনে হয় সারিকস্কি আমার ভাবনাই লিপিবদ্ধ করেছেন। আমার অপ্রকাশিত অভিজ্ঞতার কথাই বলছেন বা আমার সময় অথবা আমার দেশের সমাজের কথাই তুলে এনেছেন। সারিকস্কি বিশ্বজনীন কবি। তাঁর কবিতা পড়লে বিশ্বের অভিজ্ঞতাই পাওয়া যায়। পর মনে হয় না তাঁর কবিতা। অথচ, বললে হয়ত গোস্বা করবেন, আমাদের বেশিরভাগ কবিরা কতটা মফস্বলী। দু’একজন বাদে, আমাদের বর্তমান কবিদের পড়লে, কবিতার যে একটা দৈব এবং সর্বজনীন ভাষা ও ভাব রয়েছে তার খোঁজই যেন পাই না। আমাদের এসময়ের কবিদের কবিতা অন্তর্জগতে নিয়ে যায় না। আমাদের এসময়ের কবিরা মনে করেন কবিতায় যুতসই কিছু গালাগাল দিলেই নতুন কবিতা হয়ে যায়। সারিকস্কি কেমন কবি ছিলেন একটা কবিতা উল্লেখ করলেই আঁচ পাওয়া যাবে:
গত বসন্তে যাহারা ডুবিয়ছিল তাহাদের লাশ
ভাসিয়া উঠিতে লাগিল যখন
আমি আঁকিয়াছিলাম তাহার হাতের ছবি
*
যে শহরে প্রাণবান পানি নাই
সে শহরে মানুষ পথ হারায়
ঘনিষ্ঠ হইতে হইবে
সদাসর্বদাই,
আর ছাড়িয়াও যাওয়া চাই
(উহারা বাতসে: ২০২১: ৮৯-৯০)
অথবা আরেকটি কবিতা:
বেচারা দিয়োনুসুস এই বুড়া বয়সে
হাঁটু মুড়িয়া বসিয়াছেন পার্কে, হাত কাঁপিতেছে তাঁহার
হাতের লাঠিটা পিটাইয়া ভাঙ্গিতেছেন টুকরা টুকরা
বাহিরে আসিতেছে মেয়েছেলেদের দল
আড়াল-আবডাল ছাড়িয়া, গড়াইয়া গড়াইয়া, হাসিতে কুটিকুটি তাহারা
বেচারা দিয়োনুসুস!
সটান পড়িয়া আছেন পার্কে, শুইয়া রহিয়াছেন
দুই পা উত্তরমুখী
তাঁহার দাড়ি গজাইতেছে সবুজ, মায় ওফাতের পরেও
তাঁহার শ্বাসপ্রশ্বাাস চলিতেছে
আস্ত নগরীর মতন
যদিও পরলোকে গিয়েছেন তিনি
বেচারা দিয়োনুসুস
(উহারা বাতাসে: ২০২১: ২০)
এই কবিতা তো শুধু সুমি দেশের সুমি কবিতাই নয়। এ যেন মানব সভ্যতারই কবিতা। পূর্ব-পশ্চিম ভেদ নাই । সবারই কবিতা হয়ে উঠেছে। এরকম আরও বহু কবিতা উল্লেখ করা যায় তাঁর। যেমন:
তোমাকে ভালোবাসি
অচিনদেশের মতন
বড় বড় পাথরের সেতু
বইয়ের গন্ধমাখা সন্ধ্যার মতন
হাঁটি তুমি যেদিকে এই পৃথিবীতে
বায়ুমণ্ডলের তলায়
দুই আলোর মাঝখানে
আমার ভাবনা যাহা ছেনিতে কাটা তোমার দেহের জমিনে
(উহারা বতাসে: ২০২১: ৪৩)
এবার আসি অনুবাদকের কর্ম প্রসঙ্গে। পেন্টি সারিকস্কির কবিতার অনুবাদ বাদেও এই বইয়ে আমাদের উপরি পাওনা অনুবাদকের ষোল পৃষ্ঠার একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ভূমিকায় অনুবাদক কবি পেন্টি সারিকস্কি ও তাঁর দেশ সম্পর্কে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সারিকস্কির সুমি ভাষা নিয়েও আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন। কবিকে কিভাবে বোঝা যায়, তাঁর কবিতা, না তাঁর জীবনচরিতের মধ্য দিয়ে, সে বিষয়ে প্রচিলত রেওয়াজকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। গোলাম মুরশিদ সাহেব তো ছাড়, সুমি ভাষার জীবনীকার এবং বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনা করতেও তিনি ছাড়েন নাই। বঙ্কিম লিখেছিলেন:
‘কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ। কবিতা দর্পন মাত্র—তাহার ভিতর কবির অবিকল ছায়া আছে। দর্পন বুঝিয়া কি হইবে? ভিতরে যাহার ছায়া, ছায়া দেখিয়া তাহাকে বুঝিব। কবিতা কবির কীর্ত্তি—তাহা ত আমাদের হাতেই আছে—পড়িলেই বুঝিব। কিন্তু যিনি এই কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন, তিনি কি গুনে, কি প্রকারে, এই কীর্ত্তি রাখিয়া গেলেন, তাহাই বুঝিতে হইবে। তাহাই জীবনী ও সমালোচনাদত্ত প্রধান শিক্ষা ও জীবনী ও সমালোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।’ (উহারা বাতাসে: ২০২১: ১৫)
বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের ঘোরতর বিরোধিতা করেছেন সারিকস্কির অনুবাদক সলিমুল্লাহ খান। তিনি লিখেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের শিক্ষা হিতে বিপরীত হতে পারে। কবির জীবনচরিতের মধ্যে কবিকে বোঝা ভুল। এর মাধ্যমে আসল কবিকে পাওয়া যাবে না। তিনি লিখেছেন, ‘কবিকে বুঝতে হলে কবিতার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। তাঁর ভাষায়: ‘জীবনচরিতের মধ্যে কবিকে কতখানি পাওয়া যায় জানি না। আমার বরং ধারণা, কবিতার মধ্যেই- ইচ্ছা হয়- কবির জীবন খুঁজিয়া পাওয়া সহজ। কারণ কবিতা দর্পন মাত্র নহে, কবিতার আসল মূলধন ভাষা (উহারা বাতাসে: ২০২১: ১৮)। ’
এবার আসি কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলে রাখি, সুমি ভাষা আমার আয়ত্তে নাই বা অপরাপর ইউরোপীয় ভাষায় গভীর দক্ষতা নাই। অনুবাদকও অকপটে বলেছেন, সুমি ভাষা তাঁরও বিশেষ দখলে নাই। তবে তিনি জানিয়েছেন ইউরোপের প্রায় ডজনখানেক ভাষায় পেন্টি সারিকস্কির কবিতা অনূদিত হয়েছে। যদিও সারিকস্কির কবিতার ইংরেজী অনুবাদ অনুসরণ করেই অনুবাদক তাঁর কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন। তবে কবির ইংরেজী অনুবাদও মূলের কাছাকাছি বলা যায়, যেহেতু কবি নিজে তাঁর অনেক কবিতা অনুবাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। সারিকস্কির কিছু ইংরেজী অনুবাদ ইন্টারনেটযোগে পাওয়া যায়। সেগুলো কয়েকটি আমি পড়েছি। সেগুলোতে কবিতার স্বাদ যতটা পেয়েছি, তার থেকে এই বাংলা অনুবাদে কবিতার স্বাদ আরও অনেক বেশি পেয়েছি। কবিতার অন্দরমহলে এই অনুবাদ পড়ে আরও গভীরভাবে প্রবেশ করতে পেরেছি, একথা বলতে পারি। সলিমুল্লাহ খানের অনুবাদ পড়ে মনে হয়েছে পেন্টি সারিকস্কি যেনবা কবিতাগুলো বাংলা ভাষাতেই লিখেছেন। বইটি পড়ে বোঝা যায় অনুবাদক অতি যত্নের সাথে কবিতাগুলো বাছাই করেছেন এবং অধ্যায়ে ভাগ করেছেন।
বইটিতে কবির ১৯৫৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত লেখা কবিতা রয়েছে। বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার এক নতুন প্রকাশনী মধুপোক। বইটি হাতে পেয়ে ভেবেছিলাম, এটি হয়ত সুমি দেশ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের এই বাংলায় এত যত্ন করে বইয়ের প্রকাশ দেখিনি। মধুপোক আরও বৃহৎ হোক, এই কামনা। আমাদের প্রকাশনা আরও বিকশিত হোক। বইটি কিনতে গেলে ৪৫০ টাকা খরচ করতে হবে। যতদূর দেখেছি রকমারিতে বইটির জন্য আদেশ করা যাবে। একটি কথা বলতে পারি, বইটি কিনে পাঠকরা ঠকবেন না।
পেন্টি সারিকস্কি, উহারা বাতাসে, কবিতা ১৯৫৮-১৯৮০, সলিমুল্লাহ খান অনূদিত ( ঢাকা: মধুপোক, ২০২১), দাম ৬০০ টাকা, প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত।